সাম্যবাদী
“সাম্যবাদী কবিতা” টির লেখক আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ সাল)। তাঁর জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রাম। কাজী নজরুল ইসলাম রচিত সাম্যবাদী কবিতাটি আবদুল কাদির সম্পাদিত বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাবলি’র প্রথম খন্দড থেকে সংকলিত হয়েছে।
সাম্যবাদী কবিতার মূলভাবঃ
এই কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কবির বিশ্বাস মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে পরিচিত হয়ে ওঠা সবচেয়ে সম্মানের। কিন্তু মানুষ সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে রাজনীতি করে, দুর্বলকে শােষণ করে, এখনও একের বিরুদ্ধে অন্যকে উস্কে দেয়। এক জনের প্রতি অন্য জনকে বিমুখ করার ষড়যন্ত্র করে। নজরুলের এ আদর্শ আজও প্রতিটি মানুষের জীবনপথের প্রেরণা।
নজরুল এ কবিতায় বলেছেন- “মানুষেরই মাঝে স্বৰ্গনরক মানুষেতে সুরাসুর।” নজরুল জোর দেন অন্তর ধর্মের ওপর। ধর্মগ্রন্থ পড়ে অর্জিত জ্ঞান যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে প্রয়ােজন মানবিকতাবােধ। কবি বলেছেন মানুষের হৃদয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন মন্দির কাবা নেই। কবি সকল মত, সকল পথের উপরে স্থান দিয়েছেন মানবিকতা। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলিম সকলকে একই মায়ের সন্তানের মতাে ভেবেছেন। নজরুল মানবিক মেলবন্ধনের জন্য সংগীত রচনা করেছেন। বাণী ও সুরের মাধ্যমে মানবতার সুবাস ছড়ানাের চেষ্টা করেছেন।
নজরুল ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় মন্দির, মসজিদ, গির্জা বা অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রের মতাে পবিত্র মনে করেছেন মানুষের হৃদয়কে। এ হৃদয় যদি পবিত্র থাকে, হৃদয়ে যদি কারাে প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ না থাকে, সকলের প্রতি সমদর্শিতা থাকে তাহলে পৃথিবী হবে সুখের আবাসস্থল। সাম্যবাদ মানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বিৰ্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল মানুষের সমান অধিকার থাকা উচিত এ মতবাদ। কাজী নজরুল ইসলাম তার সাম্যবাদী’ কবিতায় সব ধরনের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সাম্যবাদের বাণী প্রচার করেছেন।
মানুষ কবিতার মূলভাব
‘মানুষ’ কবিতায় কবি সাম্যবাদের দৃষ্টিতে পৃথিবীর সব মানুষ এক ও অভিন্ন জাতি এই সত্যটি তুলে ধরেছেন। কবি এখানে ধর্ম, বর্ণ, গােত্র, জাতি প্রভৃতির বাইরে মানুষের আসল পরিচয় সম্পর্কে আলােকপাত করেছেন। মানবসেবা মহান কাজ, ক্ষুধার্তকে অনুদান সব ধর্মে স্বীকৃত। কিন্তু ‘মানুষ’ কবিতায় ক্ষুধার্ত ব্যক্তিটি মন্দিরের পূজারি এবং মসজিদের মােল্লা দ্বারা নিগৃহীত হয়েছে। সাত দিন ভুখা ফাকা থাকার কথা বলেও সে খাবার প্রার্থনা করে তাদের কাছে বঞ্চিত হয়েছে। অথচ আশি বছর ধরে কোনাে প্রার্থনা ছাড়াই প্রভুর দেওয়া খাবার খেয়ে বেঁচে আছে। মানুষের মর্যাদা, সম্মান, উচ্চাসন সবকিছু স্রষ্টার কাছে সমানভাবে বিচায় । অথচ মানুষ তাকে ধর্মের নামে, জাতের নামে ভিন্ন ভিন্ন করে দেখে। মসজিদে-মন্দিরে মােল্লা-পুরুতের আধিপত্য চলে। ভজনালয়ে, খােদার ঘরে কপাট লাগিয়ে যারা তালা দেয়, তারা মানবতার শত্রু, সাম্যের শত্রু। তাদের প্রতিহত করতে সাধারণ মানুষ হাতুড়ি, শাবল নিয়ে একদিন এগিয়ে আসবে। আর তাতে জগতে মানবতার, সাম্যের, শক্তির, জয়ের নিশান উড়বে। কাজেই মানুষকে ঘৃণা করে শুধু ধর্মগ্রন্থ পাঠ, ধর্মালয়ের সেবা অযৌক্তিক, অধর্মের নামান্তর।
কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতার সারাংশ, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ
কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতাটি তাঁর সর্বহারা কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি নজরুল ইসলামের লেখা একটি অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা। অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই কবিতায় কবি ভারতের যুব সমাজ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছেন। পরাধীন জাতির কাছে স্বাধীনতাই যখন সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য, সেই সময়েও কিছু স্বার্থান্বষী মানুষ হিন্দু-মুসলিম বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজকে দু টুকরো করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। চারিদিকে যখন চরম প্রতিকূল অবস্থা, সেই সময় সাম্প্রদায়িক বিভেদ, হানাহানি ও দাঙ্গার ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এ হেন পরিস্থিতিতে সংগ্রামী যুবসমাজের প্রতি কবির আহ্বান: “কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।” জাতির ভাগ্য যাদের উপর নির্ভর করে আছে, তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশের হাল ধরার জন্য। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় রাত্রিবেলা যেমন নৌকার হাল ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, যাত্রীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন তথা সমগ্র জাতির ভবিষ্যতের অভিমুখ ঠিক করাও সেই সময়ে কঠিন হয়ে উঠেছিলো। জাতির কর্ণধারকে কবি মনে করিয়ে দিয়েছেন, “কাণ্ডারী, বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।” স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূতকে কবি মনে করিয়ে দিয়েছেন পলাশীর প্রান্তরে বাঙালির স্বাধীনতা হারানোর কথা। ওই গঙ্গার জলেই আবার বাঙালির রক্তে লাল হয়ে স্বাধীনতার নতুন সূর্য উঠে আসবে। এ যেন কর্ণধারের কাছেও হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদের ঊর্ধে উঠে দেশের স্বার্থে লড়াই করার পরীক্ষা। তাই কবি বলেছেন “আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ।” দেশের জন্য লড়াই করতে গিয়ে যাঁরা ফাঁসির দড়ি গলায় পরে জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন, সেই মহান বিপ্লবীরাও আজ অলক্ষ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের বলিদানের কথা কাণ্ডারী যেন ভুলে না যান।
বিদ্রোহী কবিতা
বিদ্রোহী কবিতা কাজী নজরুল ইসলাম এর বিখ্যাত কবিতাসমূহের একটি। কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ধূমকেতুতে (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়। প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এটি ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি “চির উন্নত শির” বিরাজমান। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মূলত আত্মজাগরণের কবিতা। মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। এমন একটি সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাসের জয়গান ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চরণে চরণে সুস্পষ্টরূপে দেদীপ্যমান। আত্মমুক্তির মাধ্যমে জগৎ ও জীবনকে স্বাধীনতার স্বাদ উপলব্ধি করানো যায়। কবিতাটিতে ১২১ বার ‘আমি’ শব্দ ব্যবহার করে কবি একটি কথারই প্রতিধ্বনি করতে চেয়েছেন যে, মানুষ অসম শক্তির অধিকারী। সাধনা ও সংগ্রামে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বপ্নের স্বাধীন দেশ বিনির্মাণ সম্ভব। সাম্য, সত্য, সততা, অসাম্প্রদায়িকতা ও ন্যায়নির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠায় এ কবিতার অবদান বিশ্ববিশ্রুত।
বিদ্রোহী কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে, শৃঙ্খলপরা আমিত্বের বিরুদ্ধে। এই কবিতারচনার জন্য নজরুল ‘বিদ্রোহী কবির আখ্যা পেয়েছেন।