Political Theory – রাজনৈতিক তত্ব

PRC Foundation

The best way of learning and gaining

First Year

Political Theory – রাজনৈতিক তত্ব

  1. প্রশ্ন : আইন কি? আইনের উৎস সমূহ আলোচনা করো।
  2. প্রশ্ন: অ্যারিস্টোটলের মতে বিপ্লবের কারণ ও প্রতিকারের উপায় সমূহ আলোচনা কর।
  3. প্রশ্ন: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা আলোচনা কর।
  4. প্রশ্ন: আমলাতন্ত্র বলতে কি বুঝ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা আলোচনা কর ।
  5. প্রশ্ন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর।
  6. প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি? রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতি সমূহ বর্ণনা কর।
  7. প্রশ্ন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর।
  8. প্রশ্ন: নির্বাচকমণ্ডলী কী? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা আলোচনা কর।
  9. প্রশ্ন: মানব প্রকৃতি সম্পর্কে টমাস হবসের ধারণা আলোচনা করো।
  10. রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত সামাজিক চুক্তি মতবাদ টি ব্যাখ্যা করো
  11. স্বাধীনতার রক্ষাকবচ সমূহ আলোচনা করো।
  12. রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব বর্ণনা করো।
  13. ম্যাকিয়াভেলিবাদ কী? ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন?
  14. প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব টি আলোচনা করো।

1.প্রশ্ন: আইন কি? আইনের উৎস সমূহ আলোচনা করো।

ভূমিকা: আইন একটি ফারসি শব্দ। ফারসি ভাষায় এর অর্থ হল সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতি। অর্থাৎ ব্যক্তির বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্র বা সমাজ  কর্তৃক গৃহীত, সমর্থিত ও প্রযুক্ত  নিয়ম কানুন ই আইন।

আইনের কয়েকটি প্রামাণ্য সংজ্ঞা:

আইনবিদ জন অস্টিনের মতে, “সার্বভৌম শক্তির আদেশই হলো আইন।”

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল বলেছেন, “আইন হলো পক্ষপাতহীন যুক্তি।”

অধ্যাপক Holland এর মতে, “আইন হলো মানুষের বাহ্যিক আচরণের নিয়ন্ত্রণ বিধি, যার সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বলবৎ করা হয়।”

উড্রো উইলসনের মতে, “আইন হলো সমাজের সেসব সু-প্রতিষ্ঠিত প্রথা ও রীতিনীতি যেগুলো সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বিধি তে পরিণত হয়েছে এবং যাদের পেছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।”

আইনবিদ গ্রে এর ভাষায়, “law is composed of the rule which the rules the courts laid down for the determination of legal right and duties.”

আইনের উৎস সমূহ: আইনের বিভিন্ন উৎস রয়েছে। আইন রাষ্ট্রের ন্যায় ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল। আইনের উৎস সমূহ নিম্নরূপ:

প্রথা রীতিনীতি: প্রথা ও রীতিনীতি হলো আইনের সবচেয়ে প্রাচীনতম উৎস। সমাজে প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন প্রকারের প্রথা প্রচলিত রয়েছে। অতীতে বিভিন্ন দ্বন্দ মীমাংসায় এসকল প্রথা ব্যবহৃত হতো। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যখন সমাজের প্রয়োজন ও কল্যাণ মনে করে এ সকল প্রথা গ্রহণ করে বা সমর্থন করে তখন তা আইনে রূপ নেয়। আর এভাবেই প্রথা আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে।

ধর্ম: ধর্ম আইনের একটি অন্যতম উৎস। মানুষ ধর্ম দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে পাপ-পুণ্য বোধের জন্ম নেয়। যে ধর্মীয় অনুশাসন গুলো সমাজ জীবনে কে শৃংখলাবদ্ধ ও বিকশিত করতে সহযোগিতা করে সেগুলো সরকার কতৃক  সমর্থন পেয়ে আইনে রূপ নেয়। বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমানদের পারিবারিক আইন তাদের স্ব-স্ব ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ধর্মকে আইনের অন্যতম উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বলেছেন যে, “আদিতে রোমান আইন কতিপয় ধর্মীয় সূত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না।”

আইনসভা: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনসভায় আইনের প্রধান উৎস। আইনসভা সমাজের প্রয়োজনের সাথে সংগতি বজায় রেখে আইন তৈরি করে, আইনের রদবদল ও সংশোধন করে থাকে। আইনসভা হল একটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদ। তাই আইনসভা জনমতকে গুরুত্ব দিয়ে আইন প্রণয়ন করে থাকে। সুতরাং আইনসভা আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

বিচারকের রায়: বিজ্ঞ বিচারকগণ অনেক সময় নিজেদের বিবেক ও অভিজ্ঞতা থেকে নতুন আইন তৈরি, প্রচলিত আইনের যথার্থতা ও ব্যাখ্যা তুলে ধরার মাধ্যমে নতুন নিয়ম নীতি তৈরি করে থাকেন।পরবর্তীতে অন্যান্য বিচারকগণ তাদের এই নিয়ম নীতি গুলো অনুসরণ করে বিচারকার্য পরিচালনা করেন। তাই বিচারকের রায় কেউ আমরা আইনের একটি উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।

ন্যায়বিচার: যুগের পরিবর্তনের ফলে প্রচলিত আইন যখন অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে কিংবা উল্লেখিত সমস্যার সমাধান প্রচলিত আইনের মধ্যে না পাওয়া যায় বিচারকগণ তখন নিজের বিবেক ও ন্যায়বোধ খাটিয়ে আইন তৈরি করেন। এভাবেও নতুন আইনের সৃষ্টি হয়।

নির্বাহী ডিগ্রি ও ঘোষণা: সংসদীয় গণতন্ত্রে আইনসভা কে আইনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করা হলেও মূলত শাসন বিভাগীয় যাবতীয় ক্ষমতা মন্ত্রিপরিষদের হাতে ন্যস্ত থাকে। এর ফলে মন্ত্রিপরিষদ অনেক সময় অনেক আদেশ-নিষেধ জারি করেন যা আইন হিসেবে গৃহীত হয়।

সংবিধান: সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকার সহ সকল ধরনের অধিকার ও রাষ্ট্রপরিচালনার বিধি-বিধান উল্লেখ থাকে। সংবিধানের সাথে সংঘর্ষ পূর্ণ কোন আদেশ-নির্দেশ আইন হতে পারে না। তাই বলা যায় সংবিধান আইনের প্রধান উৎস।

জনমত: অনেকেই জনমতকে আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রপরিচালনায় আইনসভা সর্বদায জনমতের ভিত্তিতে আইন তৈরি করে থাকেন। তাই অপেনহেইম বলেছেন, “জনমত আইনের অন্যতম উৎস।”

উপসংহার: পরিশেষে আমরা আইন কে একটি লিপিবদ্ধ সংবিধান হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। যেহেতু একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের লোক বাস করে, সেহেতু আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধর্ম, প্রথাগত বিশ্বাস ও একাধিক বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

2.প্রশ্ন: অ্যারিস্টোটলের মতে বিপ্লবের কারণ প্রতিকারের উপায় সমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকা: বিপ্লববাদ এরিস্টোটলের এক গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। বিপ্লবকে তিনি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বিপ্লবের আওতায় ফেলেছেন। সরকার সংবিধান সংক্রান্ত যে কোন পরিবর্তনকে বিপ্লব বলে মন্তব্য করেছেন।প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্র গুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সরকারব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তন। আর এই দ্রুত পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতো।এই পরিস্থিতিতে আশার আলো হয়ে জাতিকে হতাশার অন্ধকার দূর করেন এরিস্টোটল। রাষ্ট্রের যাবতীয় সমস্যা সমাধানে তার বিপ্লব তত্ত্ব অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছে। বিপ্লব সম্পর্কে তিনি তার মতামতের ব্যাখ্যা ও নিবারণের উপায়সমূহ সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করেছেন।

এরিস্টোটলের বিপ্লবের কারণ সমূহ: এরিস্টোটল তার The Politics এর প্রথম পুস্তকে বহু গবেষণা লব্ধ বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন । তিনি বিপ্লবের কারণ কে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: বিপ্লবের সাধারণ কারণ এবং বিপ্লবের বিশেষ কারণ । নিম্নে এই কারণগুলো বর্ণনা করা হলো:

বিপ্লবের সাধারণ কারণ এরিস্টোটলের বিপ্লবের সাধারণ কারণ হিসেবে নিম্নের কারণগুলো আলোচনা করা হলো:

মনস্তাত্ত্বিক উদ্দেশ্য: মনস্তাত্ত্বিক উদ্দেশ্য হলো বিপ্লবের মূল কারণ। যখন একদল লোক মনে করে যে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যাক্তিদের মতোই তারা যোগ্যতার দিক দিয়ে সমপর্যায়ের অথচ শাসন ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত। এই অসাম্যই বিপ্লবের ইন্ধন যোগায়।

মুনাফা সম্মান লাভের বাসনা: মুনাফা ও সম্মান লাভের বাসনা ও বিপ্লবের একটি প্রধান কারণ।সরকার এবং সংবিধানের পরিবর্তনের সাথে বিপ্লব কথাটি জড়িত থাকলেও ব্যাক্তিস্বার্থ এর সাথে সম্পৃক্ত থাকে না এটা বলা যায় না। মুনাফা বা লাভ এবং সম্মান না থাকলে যে ক্ষতি হয় সেটা অনুধাবন করে মানুষ বিপ্লবী হয়।

ক্ষমতার অপব্যবহার: এরিস্টোটল বলেন যে শাসক যখন জনকল্যাণ বাদ দিয়ে সরকারি তহবিল আত্মসাৎ  করে নিজেরা মুনাফা অর্জন করে তখন জনগণ বিপ্লবী হয়ে ওঠে।

সম্পদের অসম বন্টন: রাষ্ট্রের স্বল্প কিছু লোকের হাতে বেশিরভাগ সম্পদ থাকলে অন্যরা নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। যার ফলে তারা বিপ্লবের জড়িয়ে পড়ে।

দুর্নীতি: রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তি যখন দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের সম্পত্তি বেদখল করে তখন যদি জনগণ বিরোধী হয় তবে বিপ্লব অনিবার্য।

বিপ্লবের বিশেষ কারণ: অ্যারিস্টোটলের বিপ্লবের বিশেষ কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিপ্লব: শাসকশ্রেণী ও গন বক্তারা তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে ধনীদের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করেন তখন ধনীরা একত্রিত হয়ে বিপ্লব ঘটায়।

ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বিপ্লব: ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সরকার যখন জনগণের প্রতি অন্যায় ভাবে জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন চালায় এবং অহেতুক মামলার মাধ্যমে হয়রানিমূলক কাজে লিপ্ত হয় তখন বিপ্লব ঘটে।

শাসকের অসতর্কতা: এরিস্টোটল বলেন রাষ্ট্রের শাসক কে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে তা না হলে বিপ্লব অনিবার্য।

এছাড়াও এরিস্টোটল বিপ্লবের আরো অনেক কারণ দেখিয়েছেন। যেমন রাষ্ট্রীয় সম্মান বা খেতাব, ঘৃণ্য মনোভাব সৃষ্টি, শাসকদের চক্রান্ত, নির্বাচনে চক্রান্ত, জনবিচ্ছিন্ন সরকার, অভিজাততন্ত্রে বিপ্লব, রাজতন্ত্রে বিপ্লব, স্বৈরতন্ত্রে বিপ্লব ইত্যাদি।

এরিস্টোটলের বিপ্লব প্রতিকারের উপায় সমূহ: এরিস্টোটল বিপ্লবের শুধু কারণ নির্দেশ করেননি,এর নিরাময়ের উপায় গুলো উল্লেখ করেছেন। নিচে নিবারণের উপায় গুলো আলোচনা করা হলো:

আইন মান্য করা: আইনের প্রতি আনুগত্যশীল হতে হবে। প্রত্যেকে যদি আইন মান্য করে চলে তবে বিপ্লব ঘটবে না। অবশ্য শাসকদের প্রতি আস্থা না থাকলে স্বেচ্ছাধীনভাবে আইন মান্য করতে পারে না।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ: ক্ষমতা এক হাতে থাকলে যে কুফল দেখা দেয় তা বিপ্লবের পথ কে ত্বরান্বিত করে। সকল ক্ষমতা এক হাতে থাকায় একনায়কতান্তিক  শাসন কায়েম হতে পারে।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা বিপ্লব দূরীকরণে সহায়ক নয়।

শিক্ষা: নাগরিক সাধারণকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে এবং শিক্ষা কারিকুলাম হবে রাষ্ট্রীয় আদর্শ সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

দেশপ্রেম: দেশের প্রতি ভালোবাসার ভাব সৃষ্টি করতে হবে। দেশমাতৃকার প্রতি দরদ সৃষ্টি করতে না পারা একটি অপরাধ, আর তা করতে ব্যর্থ হলে বিপ্লব ঘটতে পারে।

শাসকের ন্যায়-নীতি: শাসকবর্গ ন্যায়বান হবেন, জনগণের কল্যাণ করবেন এবং সাধারণের অর্থের অপচয় করবেন না। শাসকের ন্যায়পরায়নতা বিপ্লব দমনের উৎকৃষ্ট পদক্ষেপ বলে বিবেচিত।

গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রদর্শন: শাসন ব্যবস্থায় যারা অংশগ্রহণ করে তাদের এবং নিজেদের আচরণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে।

সমতা আনয়ন: রাষ্ট্রে যাতে জাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা বজায় থাকে শাসককে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সমাজের সব মানুষকে সমানভাবে বিবেচনা করতে হবে।

শাসকের কর্মের ওপর দৃষ্টি: শাসকশ্রেণীর ওপর অতিরিক্ত বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত নয়। কারণ তাতে জনগণের প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই শাসকের কর্মের প্রতি সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

স্বার্থপরতা ত্যাগ: ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা যাতে গজিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণীগুলোর মাত্রাতিরিক্ত সম্পদ লাভের ব্যাপারে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে।

তাছাড়া আরও কিছু উপায় রয়েছে বিপ্লব নিরাময়ের জন্য। যেমন যোগ্যতার স্বীকৃতি, সরকারি সাংগঠনিক ব্যবস্থা, শাসক ও শোষিতের মধ্যে সম্পর্ক, সরকারি অফিসের ভাগাভাগি, আগ্রাসন দূর করা, সমন্বিত সরকার ইত্যাদি।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে এরিস্টোটল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এরিস্টোটলই প্রথম ব্যক্তি যিনি বিপ্লবের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করেছেন এবং বিপ্লব প্রতিরোধের জন্য কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন। বিপ্লব নিবারণের জন্য তিনি যেসব পন্থা অবলম্বনের কথা উল্লেখ করেছেন তা আজও ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

3.প্রশ্ন: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা আলোচনা কর।

ভূমিকা: গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। দল ব্যবস্থা আলোচনা করতে গেলে সাধারণভাবে আমরা ক্ষমতাশীল দলের প্রতি অধিক নজর দেই। আসলে কিন্তু দল বলতে ক্ষমতাশীল বা বিরোধী দলকে এক সাথে বুঝায়।  দেশে গণতান্ত্রিক শাসনের উন্নয়ন ও বিকাশ সাধনে বিরোধী দল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা: বর্তমানে যে কোন দেশের শাসনব্যবস্থায় বিরোধীদল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রয়েছে। নিম্নে আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা আলোচনা করা হলো:

সরকারকে সঠিক পথে পরিচালনা: সরকারকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য বিরোধী দলের বিকল্প হয় না। বিরোধীদল সবসময় সরকারকে সঠিক পথে চলতে বাধ্য করে।

অধিকার বাস্তবায়ন: জনগণের অধিকার বাস্তবায়নে বিরোধীদল তৎপর থাকে। কোন সময়ে অধিকার খর্বিত হলে তা বাস্তবায়নের জোর তাগিদ দেয়।

মোর্চা গঠন:  সরকার বিরোধী দলগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করলে। সকল দল গঠন করতে পারে মোর্চা রাজনীতিতে একটি বড় শক্তি।

রাজনৈতিক শিক্ষা: জনসাধারণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বিরোধী দল বিশেষ আবশ্যক। সরকার কি করছে সে সম্পর্কে জনগণ বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সেমিনার এর মাধ্যমে অবহিত হয় যা জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে সহায়তা প্রদান করে।

সরকারের পরামর্শদাতা: বিরোধীদল দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার প্রকৃতি নির্ধারণ ও উক্ত সমস্যা গুলোর সমাধান কল্পে আইনসভার কর্মসূচি প্রণয়নে  সরকারকে সহায়তা করে। বস্তুতপক্ষে বিরোধীদল আইনসভার বিভিন্নমুখী কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সরকারি দলকে সহযোগিতা করে।

বিকল্প কর্মসূচি পেশ: বিরোধীদল জনগনের সামনে সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি বিকল্প কর্মসুচির পেশ করে থাকে । বিশেষ করে নির্বাচনের পূর্বে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে এ ধরনের বিকল্প কর্মসূচি জনসমক্ষে প্রচার করা হয়। ফলে জনগণ একের অধিক কর্মসূচির মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়।

জনসেবা: জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বিরোধী দল শুধু সরকারের সমালোচনায‌ই করে না, অনেক জনকল্যাণকর কার্যাদিও সমাধান করে থাকে।

পারস্পারিক সম্পর্ক: দেশের সকল দলের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সরকারি দল ও বিরোধী দল সমানভাবে দায়িত্ব পালন ক করে। দলের মধ্যে সুসম্পর্ক  না থাকলে গণতন্ত্রের মঙ্গল হয় না।

বাদ্যযন্ত্র: অনেক রাজনীতিবিদ সরকারকে একটি বাদ্যযন্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন। সেখানে কোনো একটি দল সহযোগিতা না নিলে সে বাদ্যযন্ত্রের ছন্দ পতন হতে বাধ্য।

জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখা ও উন্নত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐক্যমত পোষণ করা দরকার । এ ক্ষেত্রে সরকারি দল ও বিরোধী দল পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে পারে। যা সত্যিকারে দেশের কল্যাণ বয়ে আনে।

আইন প্রণয়নের সহায়তা: আইন প্রণয়নে বিরোধীদল সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করে । সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আইন প্রণয়নে যথেষ্ট না হলে বিরোধী দল সে ক্ষেত্রে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমর্থনের কথা উল্লেখ করতে পারি।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এজন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় প্রশ্নে বিরোধীদল ঐক্যমত পোষণ করে। যার ফলে কোন সংঘ বিচ্ছিন্নভাবে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে না।

গঠনমূলক সমালোচনা: সরকারের প্রতিটি কাজের ত্রুটি-বিচ্যুতির গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা বিরোধী দলের প্রধান কাজ। বিরোধীদলের ভয়ে ক্ষমতাসীন দল ইচ্ছা মতো কোনো কাজ করতে পারে না।

সরকারি দলের স্বেচ্ছাচারিতার রোধ: বিরোধী দল সরকারি দলের কার্যকলাপের সমালোচনা করে স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করে। আইনসভার ভিতর ও বাহিরে বক্তৃতা ও বিবৃতি এবং দলের সমালোচনার দ্বারা সরকারকে আইন সীমার মধ্যে কাজ করতে বাধ্য করে। আর এর ফলে সরকারি দল জনকল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত রাখতে বাধ্য হয়।

বিকল্প সরকার: বিরোধীদলের অস্তিত্বের সাথে গণতন্ত্র পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা বিরোধী দলেই বিকল্প সরকার হিসেবে কাজ করে। ব্রিটেনে বিরোধী দল  ছায়া সরকার রূপে কাজ করে থাকে।

গণতন্ত্র রক্ষায় বিরোধীদল: গণতন্ত্র রক্ষায় অগ্রদূত হিসেবে বিরোধীদল কাজ করে থাকে। সরকারের যদি কোন ক্রমে পতন হয় কিন্তু সেখানে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে শাসন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিতে পারে। শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে গণতন্ত্রের ধারা ব্যাহত হয় না। আর এজন্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিল বলেছেন’ “যেখানে বিরোধী দল নেই সেখানে গণতন্ত্র নেই ।”

উপসংহার: পরিশেষে আমরা এক বাক্যে বলতে পারি যে, গণতন্ত্রের সফলতায় বিরোধীদল বিশেষ প্রয়োজন। সুতরাং সরকারি এবং বিরোধীদল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমানতালে দেশ পরিচালনায় অংশ নিবে সেটা সকলের‌ই ঐকান্তিক কামনা ও বাসনা।

4.প্রশ্ন: আমলাতন্ত্র বলতে কি বুঝ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা আলোচনা কর ।

ভূমিকা: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রশাসন পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি আমলাতন্ত্র। সরকারের নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য আমলাতন্ত্রের বিকল্প নেই। আমলাতন্ত্রকে কোন দেশের উন্নয়নের বাহক বলা হয়। আমলারা যা করে তা দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অপরিসীম। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের পরিধি ও বিস্তৃতির সাথে আমলাতন্ত্রের পরিধি ও গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।


আমলাতন্ত্র: আমলাতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ Bureaucracy। আমলাতন্ত্র বলতে স্থায়ী, বেতনভুক্ত, দক্ষ ও পেশাদার কর্মচারীদের সংগঠনকে বোঝায়। তাছাড়া আমলাতন্ত্র বলতে আমলা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের শাসন বোঝায়। যে সংগঠন দেশের উন্নয়ন করতে সরকারের সহযোগিতা করার জন্য সুশৃংখলভাবে পরস্পর-সংযুক্ত থেকে কাজ করে, তাকে আমলাতন্ত্র বলে।


প্রামাণ্য সংজ্ঞা:

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, “Bureaucracy is a system of administration characterized by expertness  impartiality and the absence of humanity.”


অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, ” Bureaucracy is a system of government, the control of which is so completely in the hands of the officials that their power jeopardizes the liberties of ordinary citizens.”


অর্থাৎ আমলাতন্ত্র বলতে সাধারণত সেই ধরনের শাসনব্যবস্থা কে বোঝায়, যে শাসনব্যবস্থাকে সরকারি কর্মকর্তাগণ এত পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন যে, তাদের ক্ষমতা সাধারণ নাগরিকদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।


গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা: বর্তমান বিশ্বের আধুনিক রাষ্ট্রসমূহে  ‌আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এটি একটি অপরিহার্য অংশ। আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের নানাবিধ কার্যাবলী সম্পাদন করতে হয়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:


নীতি প্রনয়ন: বর্তমানকালে জ্ঞান বিজ্ঞানে প্রযুক্তির প্রসারের ফলে মানুষ সচেতন হয়ে উঠেছে। সরকারের কাছে তারা তাদের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে সরকারের দায়িত্ব ও কার্যাবলি প্রসারিত হয়েছে। তাই সরকারকে অনেক নীতি নির্ধারণ করতে হচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষে আমলারা নীতি প্রণয়ন করে থাকেন।


সরকারের নীতি বাস্তবায়ন: আমলাতন্ত্র সরকারি নীতি প্রণয়ন করে বসে থাকে না, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এসব নীতি বাস্তবায়ন করা আমলাদের অন্যতম দায়িত্ব।


আইন প্রণয়ন করা: সংসদে উত্থাপিত বেশিরভাগ বিলই প্রশাসনিক বিভাগ কর্তৃক তৈরি করা হয়। আর এসব বিষয়ে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য কেননা এরা বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে থাকেন। দেশের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমলারাই রাজনীতিবিদদের সহায়তা করে থাকেন।


আইন বাস্তবায়ন করা: আইন প্রণয়ন করা যতটুকু না দায়িত্ব, তার চেয়ে আমলাতন্ত্রের বড় দায়িত্ব হলো আইন কার্যকর করা। আমলাতন্ত্র কোন আইনকে বাতিল বা তাদের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে আইন কে কার্যকর করে তোলেন। আধুনিক রাষ্ট্রের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


মন্ত্রীদের সহায়তা: প্রত্যেকটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার মন্ত্রীগণ প্রশাসনিকভাবে দক্ষতাসম্পন্ন হন না। তাদের সংসদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এজন্য আমলারই তাদের উত্তর দেন এবং তাদের সব বক্তব্য আমলারা লিখে দেন।


জনস্বার্থমূলক কাজ: আমলাতন্ত্র সরকারের জনস্বার্থমূলক কাজগুলো করে থাকে। এসব কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শিক্ষা,স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, সংস্থাপন ব্যবস্থা, রাজস্ব ব্যবস্থা ও কর ব্যবস্থা ইত্যাদি।


পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত: সাম্প্রতিককালে পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক সম্পর্কের খুটিনাটি বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পিত থাকে আমালাদের ওপর। আন্তর্জাতিক  আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়  আমলারাই দেশের প্রতিনিধিত্ব করে।


বাজেট প্রণয়ন: প্রত্যেকটি রাষ্ট্রেই কয়েক বছরের জন্য একটা আয়-ব্যয়ের হিসাব করা হয় আর একে বাজেট বলা হয়। এ কাজের জন্য আমলাদের সাহায্য বিশেষভাবে দরকার।


আমদানি রপ্তানি নীতি: প্রত্যেকটি দেশের কিছু আমদানি ও রপ্তানি নীতি আছে। একটি দেশের আমদানি ও রপ্তানি কাজ সম্পাদনে আমলাতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মূলত আমলাদের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়ে থাকে।


জনগণ সরকারের সম্পর্ক: গণতান্ত্রিক দেশের আমলাতন্ত্র হলো সরকার ও জনগণের সেতুবন্ধন। এর মাধ্যমে জনগণ সরকারের সম্বন্ধে জানতে পারে। জনগণ আমলাদের তাদের প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত করে এবং আমলারা সেটা সরকারের কাছে পৌঁছে দেয়। এতে করে সরকার ও জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে।


প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি:  যেকোনো দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায় আমলাতন্ত্রের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। এতে প্রশাসনের উৎকর্ষ সাধন হয়।


বাণিজ্যিক চুক্তি: বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের কোন পণ্যদ্রব্য রপ্তানি করা হবে, কোন পণ্য আমদানি করা হবে, কোন দেশে রপ্তানি করা হবে, কোন দেশ থেকে আমদানি করা হবে এসব বিষয়ে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা: কোন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার অন্যতম সংগঠন হলো আমলাতন্ত্র। আর একটি সংগঠন হিসেবে আমলাতন্ত্র কোন দেশের শৃঙ্খলা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে।


আইনসভাকে প্রভাবিত করা: আমলাতন্ত্র দ্বারা কোন দেশের আইনসভাকে নিয়ন্ত্রন করা হয়। আইনসভা যে আইন পাস করে, আমলাতন্ত্র জনগণের শুনানির মাধ্যমে সে আইনের যথার্থতা যাচাই করে।


উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। আর এই জনকল্যাণমূলক কাজে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা সবথেকে বেশি।

5.প্রশ্ন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকা: গ্রিক নগররাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক ক্রান্তিকালে সমৃদ্ধ নগররাষ্ট্র যখন বিপর্যস্ত প্লেটো তখন তার বিখ্যাত গ্রন্থ “দ্য রিপাবলিক” রচনা করেন । এ গ্রন্থে প্লেটো গ্রিসের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পরিহার করে একটি উত্তম রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। প্লেটোর মতে, উন্নত জীবন হচ্ছে আদর্শ রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য। তিনি মানুষের মধ্যে ন্যায়ের উপস্থিতিকে আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাকে উপস্থাপন করেন।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য: প্লেটো তার রিপাবলিক এর মধ্যে আদর্শ রাষ্ট্রের যে চিত্র তুলে ধরেছেন নিচে তার কিছু বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:

শ্রেণীভিত্তিক প্রতিষ্ঠান:  প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র একটি শ্রেণীভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এখানে সমগ্র মানুষকে একটি বিশেষ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা: অভিভাবক যোদ্ধা ও কৃষক বা উৎপাদক শ্রেণী।

শ্রমবিভাজন নীতি: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র শ্রমবিভাজন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে শ্রমবিভাজন নীতি এবং কর্ম বিশেষীকরণ নীতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যে যার যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং কেউ কারো কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।

বিশেষশ্রেণীর শাসন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক বিশেষ শ্রেণীর শাসনের কথা বলা হয়েছে। অভিভাবক বা দার্শনিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করবে এবং অন্যকে তাদের হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: ন্যায়ধর্ম প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আদর্শ রাষ্ট্র হবে ন্যায়বিচার কায়েমের উৎকৃষ্ট স্থান। এই আদর্শ রাষ্ট্রে সকলেই নিজ নিজ দায়িত্ব ও যোগ্যতার দ্বারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে।

ব্যক্তিভিত্তিক শাসন: শাসন করবে দার্শনিক রাজাগণ এবং সেখানে আইনের কোনো শাসন দরকার হবে না। প্লেটোর কোথায় যেখানে দার্শনিকরা থাকবে সেখানে আইনের কোনো প্রয়োজন হবে না। আদর্শ রাষ্ট্র  ব্যক্তির শাসন আইনের নয়।

আদর্শ জীবন: আদর্শ রাষ্ট্র উত্তম ও সহজ জীবন যাপনের ক্ষেত্র। নাগরিকের জীবন প্রণালী উত্তম ও ন্যায়ভিত্তিক না হলে আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই প্রথমে নাগরিক সাধারণকে আদর্শ করে গড়ে তুলতে হবে।

খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান: আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য খাদ্য বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে।

গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল গণতন্তের অনুপস্থিতি। তিনি গণতন্ত্রকে অজ্ঞতা ও অযোগ্যতার শাসন বলে অভিহিত করেছেন। প্লেটোর মতে রাজনীতিবিদদের অজ্ঞতা ও অযোগ্যতা গণতন্ত্রের জন্য অভিশাপস্বরূপ।

দাসপ্রথাকে সমর্থন:  আদর্শ রাষ্ট্রকে বাস্তবায়িত করার জন্য দাসপ্রথাকে সমর্থন করেন। কেননা শাসকশ্রেণীর সুখশান্তি বিধানে এবং রাষ্ট্রের কার্যাবলী সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্য দাসদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

নারী-পুরুষের সমান অধিকার: প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের নারী-পুরুষের সমানাধিকার অধিকার ও সমদায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি পুরুষের পাশাপাশি নারী শিক্ষার অধিকার ও সুযোগের কথা বলেন। তিনি মনে করেন জনসংখ্যার অর্ধেক পিছিয়ে থাকলে সামাজিক অগ্রগতি সম্ভব না।

আদর্শ রাষ্ট্রে সমালোচনা: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সমালোচনা নিচে আলোচনা করা হলো:

শ্রেণীভিত্তিক: আদর্শ রাষ্ট্রএকটি শ্রেণী ভিত্তিক সংগঠন । এখানে শ্রেণীশাসন কার্যকর করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কল্পনামাত্র: আদর্শ রাষ্ট্র একটি কল্পনামাত্র এবং এর সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই। এরকম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা কখনও সম্ভব হয় নি, হবেও না। তিনি নিজেও শেষকালে বলেছেন এই রাষ্ট্র কেবল স্বর্গরাজ্যে প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

অগণতান্ত্রিক: আদর্শ রাষ্ট্র অগণতান্ত্রিক এবং এখানে স্বৈরশাসনের বীজ বপন করা হয়েছে। সর্বাত্মকবাদী শাসনের নমুনা আমরা এখান থেকে পেয়ে থাকি।

ব্যক্তির শাসন: আইনের পরিবর্তে ব্যক্তির শাসন জারি করা হয়েছে । আইন এর পরিবর্তে দার্শনিক রাজাগন দেশ শাসন করবে। এর দ্বারা স্বৈরশাসনের পথকে নির্দেশ করা হয়েছে।

অসাংবিধানিক: আদর্শ রাষ্ট্র ও সংবিধান বিবর্জিত শাসনব্যবস্থা কেননা, সংবিধানের পরিবর্তে ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালান হয়েছে।

উপসংহার: উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সমালোচনা আছে সত্য কিন্তু প্লেটো যে সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে আদর্শ রাষ্ট্রের কথা মগজ এনেছেন তাঁ স্মরণযোগ্য। এরকম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় সত্য কথা, কিন্তু করতে পারলে তা হবে স্বর্গরাজ্য সমতুল্য।

6.প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি? রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতি সমূহ বর্ণনা কর।

ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল বিজ্ঞান, তাই জন্মলগ্ন থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে এর অধ্যয়ন পদ্ধতি নিয়ে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মত স্বতসিদ্ধ কোন বিজ্ঞান না হলেও একে অনুধাবন করা এত সহজ নয়। সহজবোধ্য করতে হলে অনুশীলন পদ্ধতিজানা আবশ্যক। একটি গতিশীল হওয়ার কারণে কোন নির্দিষ্ট গবেষণা ও অনুশীলন পদ্ধতির আওতায় সীমাবদ্ধ থাকে না। আজকে যে পদ্ধতিকে সঠিক বলে মনে হবে কালকে নাও হতে পারে। নিচে রাষ্ট্র বিজ্ঞান চর্চার পদ্ধতি সমূহ আলোচনা করা হলো:

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা:  রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Political Science। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এমন একটি বিজ্ঞান, যা রাষ্ট্র ও সরকারের উদ্ভব, বিকাশ, গঠন, কাঠামো ও কার্যক্রম সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করে থাকে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা:

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলের মতে, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এমন একটি বিষয়একটি সুসংগঠিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ নগররাষ্ট্রে আদর্শ জীবনযাপনের সাথে সম্পর্কিত সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত।

অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, সংগঠিত রাষ্টের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবনের আলোচনাই হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান।

পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা রাষ্ট্র ও সরকারের যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা করে থাকে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতি সমূহ: নিচে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতিসমূহ আলোচনা করা হলো:

দার্শনিক পদ্ধতি:  রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের সবচেয়ে প্রাচীন বা সনাতন পদ্ধতি হলো দার্শনিক পদ্ধতি।দার্শনিক পদ্ধতি কোন চুক্তিভিত্তিক পদ্ধতি নয়। অনুমানের ভিত্তিতে কতকগুলো বিষয়কে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নেওয়া হয়। এই পদ্ধতির প্রবক্তা হলেন প্লেটো, টমাস মুর, হেগেল, রুশো, হবস, কান্ট প্রমুখ।

ঐতিহাসিক পদ্ধতি: ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে ইতিহাস পর্যালোচনা করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চা করা হয়। অন্যান্য বিষয়ের মত ইতিহাসের সাথে এর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট না জেনে কোন ঘটনার সঠিক পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয়। রাষ্ট্র আলোচনা করতে গেলে তার অতীত জানা প্রয়োজন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  ফ্রিম্যান এর মতে,” History is past politics, politics is present history.” । অতীতের জ্ঞান এবং বর্তমানের পর্যালোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করে।

তুলনামূলক পদ্ধতি: এই পদ্ধতির মূল কথা হলো কোন বিষয়ে জানার জন্য তুলনামূলক ব্যাখ্যা করা।এটি একটি পুরাতন পদ্ধতি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল সর্বপ্রথম এই পদ্ধতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চায় দিকনির্দেশনা হিসেবে ব্যবহৃত করেন। তিনি  আইনের শাসন, আদর্শ রাষ্ট্র, সাংবিধানিক সরকার ইত্যাদি জানার জন্য তুলনামূলকভাবে 158 রাষ্ট্রের রাষ্ট্রের সংবিধান আলোচনা করেন। তুলনামূলক পদ্ধতির অপর বিখ্যাত বইয়ের নাম হল ” Comparative  Politics” যেটি লিখেছেন M.G Smith

পরীক্ষামূলক পদ্ধতি: পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কোন কিছু জানাকে পরীক্ষামূলক পদ্ধতি বলে। নতুন নতুন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামো নির্ধারণের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগন অনেক ক্ষেত্রে গবেষণা ও পরীক্ষা করে থাকেন। এসব পরীক্ষালব্ধ ফলাফল যদি সন্তোষজনক হয় তাহলে তা রাষ্ট্রব্যবস্থা সাথে সংযুক্ত করা হয়।

আইনগত পদ্ধতি: এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য না করে একটি আইন মূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। আইন মূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইন প্রণয়ন ও আইন কার্যকরী করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পূর্ণ হয়।

সমাজবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি: মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। সমাজের বাহিরে মানুষকে কল্পনা করা অবাস্তব। সমাজের প্রতি যেমন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তেমনি রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের  একটি অংশ।

জীববিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি: এই পদ্ধতি অনুসারে রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মানুষ যেমন বহু বিবর্তনের ধাপ পেরিয়ে বর্তমানে স্তরে পৌঁছেছে তেমনি রাষ্ট্রকেও বহুস্তর অতিক্রম করতে হয়েছে। এই পদ্ধতির মূল বক্তব্য হলো রাষ্ট্রের পরিবর্তনশীলতাই হল এর ক্রমবিকাশ। অগাস্ট কোঁৎ এবং হার্বাট স্পেন্সার হল এই পদ্ধতির সমর্থক।

পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি: সনাতন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে চলমান আদর্শ, নীতি, কাঠামো, সমস্যা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগন পর্যবেক্ষণ করে তার ওপর তত্ত্ব লিপিবদ্ধ করন।

মনোবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি: মনোবিজ্ঞানের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠতা আছে বলে সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন। কেননা মানুষের মন মেজাজ জানতে না পারলে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভালোভাবে জানা যাবে না।

প্রতিষ্ঠানমূলক পদ্ধতি: বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়া-কলাপের আলোকে ঘটনাবলীর আলোচনায় রাষ্ট্র নামক বৃহত্তর সংগঠিত ও পরিচালিত হয় এসব সম্ভব হয় প্রতিষ্ঠারমূলক গবেষণা কারণে।

পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি: বিভিন্ন জরিপ মূলক কাজের জন্য এ পদ্ধতি অনুসরণীয়। সাধারণ পন্থায় কোন বিষয় উপস্থাপন করলে সহজে কেউ তার গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু যখন পরিসংখ্যান দ্বারা প্রমাণিত হয় তখন সবাই তার গুরুত্ব দেয়।

সাক্ষাৎকারমূলক পদ্ধতি: সামাজিক বিজ্ঞানে তথ্য সংগ্রহের জন্য সাক্ষাৎকার উৎকৃষ্ট পন্থা। সাক্ষাৎকার কে নমুনা জরিপ বলা হয়। কোন বিশেষ এলাকা বা জনগণের মনের ভাব জানার জন্য এই পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয়।

যোগাযোগ তত্ত্ব: জার্মান দার্শনিক জার্মান দার্শনিক কার্ল ডুয়েশচ তার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ “The Nerves of Government” নামক গ্রন্থে যোগাযোগ তত্ত্বের সূচনা করেন। এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ, শাখা-প্রশাখার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, অস্তিত্বের সংরক্ষণ, রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রভৃতি বিষয়ে বিশদ বিবরণ উল্লেখ করা হয়।

গোষ্ঠী তত্ত্ব: গোষ্ঠী তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন আর্থার বেন্টলি। 1908 সালে আর্থার বেন্টলি তার প্রকাশিত “The Process of Government: A Study of Political Pressures” গ্রন্থের সর্বপ্রথম গঠিত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। গোষ্ঠী তত্ত্বের আলোকে দেশের সকল স্তরের বিদ্যমান জনসমষ্টিকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর অধীনে বিবেচনা করা হয়।

এছাড়াও আরও বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। যেমন: সমন্বিত পদ্ধতি, সংঘ তত্ত্ব, সিস্টেম তত্ত্ব,কাঠামো কার্যগত তথ্য, শ্রেণি বিশ্লেষণ ইত্যাদি।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্লেটো এরিস্টটল এর আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বিভিন্ন অনুসন্ধান পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতি সমূহের মধ্যে এককভাবে কোনটিকে সর্বপেক্ষা গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন।

7.প্রশ্ন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকা: গ্রিক নগররাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক ক্রান্তিকালে সমৃদ্ধ নগররাষ্ট্র যখন বিপর্যস্ত প্লেটো তখন তার বিখ্যাত গ্রন্থ “দ্য রিপাবলিক” রচনা করেন । এ গ্রন্থে প্লেটো গ্রিসের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পরিহার করে একটি উত্তম রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। প্লেটোর মতে, উন্নত জীবন হচ্ছে আদর্শ রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য। তিনি মানুষের মধ্যে ন্যায়ের উপস্থিতিকে আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাকে উপস্থাপন করেন।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য: প্লেটো তার রিপাবলিক এর মধ্যে আদর্শ রাষ্ট্রের যে চিত্র তুলে ধরেছেন নিচে তার কিছু বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:

শ্রেণীভিত্তিক প্রতিষ্ঠান:  প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র একটি শ্রেণীভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এখানে সমগ্র মানুষকে একটি বিশেষ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা: অভিভাবক যোদ্ধা ও কৃষক বা উৎপাদক শ্রেণী।

শ্রমবিভাজন নীতি: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র শ্রমবিভাজন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে শ্রমবিভাজন নীতি এবং কর্ম বিশেষীকরণ নীতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যে যার যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং কেউ কারো কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।

বিশেষশ্রেণীর শাসন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক বিশেষ শ্রেণীর শাসনের কথা বলা হয়েছে। অভিভাবক বা দার্শনিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করবে এবং অন্যকে তাদের হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: ন্যায়ধর্ম প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আদর্শ রাষ্ট্র হবে ন্যায়বিচার কায়েমের উৎকৃষ্ট স্থান। এই আদর্শ রাষ্ট্রে সকলেই নিজ নিজ দায়িত্ব ও যোগ্যতার দ্বারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে।

ব্যক্তিভিত্তিক শাসন: শাসন করবে দার্শনিক রাজাগণ এবং সেখানে আইনের কোনো শাসন দরকার হবে না। প্লেটোর কোথায় যেখানে দার্শনিকরা থাকবে সেখানে আইনের কোনো প্রয়োজন হবে না। আদর্শ রাষ্ট্র  ব্যক্তির শাসন আইনের নয়।

আদর্শ জীবন: আদর্শ রাষ্ট্র উত্তম ও সহজ জীবন যাপনের ক্ষেত্র। নাগরিকের জীবন প্রণালী উত্তম ও ন্যায়ভিত্তিক না হলে আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই প্রথমে নাগরিক সাধারণকে আদর্শ করে গড়ে তুলতে হবে।

খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান: আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য খাদ্য বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে।

গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল গণতন্তের অনুপস্থিতি। তিনি গণতন্ত্রকে অজ্ঞতা ও অযোগ্যতার শাসন বলে অভিহিত করেছেন। প্লেটোর মতে রাজনীতিবিদদের অজ্ঞতা ও অযোগ্যতা গণতন্ত্রের জন্য অভিশাপস্বরূপ।

দাসপ্রথাকে সমর্থন:  আদর্শ রাষ্ট্রকে বাস্তবায়িত করার জন্য দাসপ্রথাকে সমর্থন করেন। কেননা শাসকশ্রেণীর সুখশান্তি বিধানে এবং রাষ্ট্রের কার্যাবলী সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্য দাসদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

নারী-পুরুষের সমান অধিকার: প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের নারী-পুরুষের সমানাধিকার অধিকার ও সমদায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি পুরুষের পাশাপাশি নারী শিক্ষার অধিকার ও সুযোগের কথা বলেন। তিনি মনে করেন জনসংখ্যার অর্ধেক পিছিয়ে থাকলে সামাজিক অগ্রগতি সম্ভব না।

আদর্শ রাষ্ট্রে সমালোচনা: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সমালোচনা নিচে আলোচনা করা হলো:

শ্রেণীভিত্তিক: আদর্শ রাষ্ট্রএকটি শ্রেণী ভিত্তিক সংগঠন । এখানে শ্রেণীশাসন কার্যকর করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কল্পনামাত্র: আদর্শ রাষ্ট্র একটি কল্পনামাত্র এবং এর সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই। এরকম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা কখনও সম্ভব হয় নি, হবেও না। তিনি নিজেও শেষকালে বলেছেন এই রাষ্ট্র কেবল স্বর্গরাজ্যে প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

অগণতান্ত্রিক: আদর্শ রাষ্ট্র অগণতান্ত্রিক এবং এখানে স্বৈরশাসনের বীজ বপন করা হয়েছে। সর্বাত্মকবাদী শাসনের নমুনা আমরা এখান থেকে পেয়ে থাকি।

ব্যক্তির শাসন: আইনের পরিবর্তে ব্যক্তির শাসন জারি করা হয়েছে । আইন এর পরিবর্তে দার্শনিক রাজাগন দেশ শাসন করবে। এর দ্বারা স্বৈরশাসনের পথকে নির্দেশ করা হয়েছে।

অসাংবিধানিক: আদর্শ রাষ্ট্র ও সংবিধান বিবর্জিত শাসনব্যবস্থা কেননা, সংবিধানের পরিবর্তে ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালান হয়েছে।

উপসংহার: উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সমালোচনা আছে সত্য কিন্তু প্লেটো যে সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে আদর্শ রাষ্ট্রের কথা মগজ এনেছেন তাঁ স্মরণযোগ্য। এরকম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় সত্য কথা, কিন্তু করতে পারলে তা হবে স্বর্গরাজ্য সমতুল্য।

8.প্রশ্ন: নির্বাচকমণ্ডলী কী? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা আলোচনা কর।

ভূমিকা: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র  জনগণের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে নির্বাচকমণ্ডলীর মতামত‌ই চূড়ান্ত। অনেক লেখকের নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের চতুর্থ বিভাগ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

নির্বাচকমণ্ডলী: প্রতিনিধি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে যারা ভোট দেন তাদের নির্বাচক বা ভোটার বলা হয়। আর নির্বাচকের সমষ্টিকে বলা হয় নির্বাচকমণ্ডলী। সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অন্যতম শর্ত। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমণ্ডলী আবশ্যক।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: W.F Willoughby বলেন প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে নির্বাচকমণ্ডলী”। অধ্যাপক গার্নার বলেন, নির্বাচকমণ্ডলী নাগরিকদের সেই অংশ যারা সরকার গঠন, প্রকৃতি কার্যাবলী বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার তৈরি করে।”

অতএব বলা যায় যে, নির্বাচনে প্রতিনিধি বাছাইয়ে ভোটাধিকার প্রাপ্ত ভোটারের সমষ্টি হল নির্বাচকমণ্ডলী। অর্থাৎ যে সকল নাগরিক যে কোনো নির্বাচনে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার লাভ করে তাদের সমষ্টি হল নির্বাচকমণ্ডলী।

নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা: একটি রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী নানাবিধ কাজ করে রাষ্ট্রীয়  উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। নিচে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা ও কার্যাবলী উল্লেখ করা হলো:

প্রতিনিধি নির্বাচন: নির্বাচকমণ্ডলীর প্রথম ও প্রধান কাজ রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা। এ জন্য কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করে। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধান‌ও নির্বাচক মন্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত হন। স্থানীয় পরিষদগুলোর সদস্যবৃন্দ‌ও নির্বাচিত হন।

সরকারি কাজের ওপর দৃষ্টি: সরকারের কাজের প্রতি কড়া নজর রাখে নির্বাচকমণ্ডলী। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশের সরকার পরিচালনায় সীমা লংঘন করলে নির্বাচকমণ্ডলী তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করে। জনমত গঠনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণ: প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনে নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করে। তবে গণভোট, গণ-  উদ্যোগ পদ্ধতি ইত্যাদিতে এবং আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনা নির্বাচকমণ্ডলী প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে পারে।

জনমতের মাধ্যম:  নির্বাচকমণ্ডলী জনমত গঠনের প্রধান মাধ্যম। বিভিন্ন সভা ও সমাবেশে নির্বাচকমণ্ডলীর অভিমত, নীরবতা ও সোচ্চারকণ্ঠ জনমতকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এবং সে প্রভাব দেশের সরকারক ও সমগ্র শাসনকে নাড়া দেয়।

সংবিধান সংশোধন: কোন কোন রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর রায় না জেনে সরকার শাসনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করতে পারে না। পরোক্ষভাবে নির্বাচকমণ্ডলী শাসনতন্ত্রের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রাজনৈতিক দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ: প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য জন্মলাভ করেছে রাজনৈতিক দল। কিন্তু এই রাজনৈতিক দলকে সঠিক পথে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নির্বাচকমণ্ডলী। কারণ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলসমূহকে নির্বাচকমণ্ডলীর দরবারে হাজির হতে হয়।

সরকারের অপরিহার্য অঙ্গ: রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে নির্বাচকমণ্ডলীর মতামতি চূড়ান্ত আইন শাসন ও বিচার বিভাগ আছে এবং তিন বিভাগ তিন প্রকার কাজ করে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনটি বিভাগ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি নির্বাচকমণ্ডলীও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। আর এজন্যই নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয়।

প্রতিনিধি প্রত্যাহার: নির্বাচকমণ্ডলী প্রতিনিধি নির্বাচনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে তেমনি তারা প্রতিনিধি প্রত্যাহার করতে পারে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি জনকল্যাণে কাজ না করে শুধু ব্যাক্তিস্বার্থ চেতনায় কাজ করে তাহলে নির্বাচকমণ্ডলী নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি প্রত্যাহার করতে পারে।

সরকার গঠন: নির্বাচকমণ্ডলী সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। সরকার কে হবে, সরকার গঠন করবে কে, কোন দল সরকার গঠন করবে এ বিষয়গুলো নির্বাচকমণ্ডলী নির্বাচিত করে থাকে। কারণ নির্বাচনের যে দল অধিকসংখ্যক ভোটে নির্বাচিত হবে সেই দল‌ই সরকার গঠন করবে। আর নির্বাচকমণ্ডলী ভোটের মাধ্যমে তাদের নির্বাচিত করবে।

সরকার পরিবর্তন: নির্বাচকমণ্ডলী যেমন সরকার গঠনে ভূমিকা রাখে তেমনি সরকার পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। সরকার পরিবর্তনের জন্য হয় আন্দোলন করতে হবে না হয় নির্দিষ্ট সময়ে ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে হবে। আর এই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারকে পরিবর্তন করে থাকে।

বিচারক নিয়োগ: অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী বিচারকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। নির্বাচকমণ্ডলী বিবেকসম্পন্ন, সুশিক্ষিত বিচারক নিয়োগ দিয়ে থাকেন যার ফলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত পায়।

ঐতিহ্য রক্ষা: একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে নির্বাচকমণ্ডলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্দিষ্ট মেয়াদ পরে নির্বাচন দেওয়া অথবা এক্সিস্টিং সরকার যদি ভাল হয় তাহলে তাদেরকে আবারও সরকার গঠনের দায়িত্ব দেয়া ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে নির্বাচকমণ্ডলী গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রক্ষা করে থাকে।

গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন: গণতন্ত্রের পথ কখনও মসৃণ নয়। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গণতন্ত্রের পথচলা। নির্বাচকমণ্ডলী বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে বা গণতন্ত্রের বিকাশ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

শাসন ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন: নির্বাচকমণ্ডলী শাসন ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা বা সংবিধান কেমন হবে তার রূপরেখা প্রণয়ন করে নির্বাচকমণ্ডলী। সংবিধানের রূপরেখা যদি জনগণের কল্যাণে হয় তাহলে জনগণ সেটাতে সমর্থন দেয়। আর যদি জনগণের কল্যাণের না হয় তাহলে জনগণ সেটা প্রত্যাহার করে। এভাবে নির্বাচকমণ্ডলী শাসন ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন ভূমিকা পালন করে থাকে।

স্বৈরশাসন প্রতিরোধ: নির্বাচকমণ্ডলী সরকার যেন স্বৈরাচারী না হয় সেদিকে নজর রাখে। সরকারের স্বৈরাচারীতাকে রোধ করতে পারে একমাত্র নির্বাচকমণ্ডলী।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নির্বাচকমণ্ডলীকে ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা শাসন ব্যবস্থাকে কল্পনা করা যায় না। তাই দেশ পরিচালনায় নির্বাচকমন্ডলীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

9.প্রশ্ন: মানব প্রকৃতি সম্পর্কে টমাস হবসের ধারণা আলোচনা করো।

ভূমিকা: বিজ্ঞানী ,গণিতবিদ,বস্তুবাদী দার্শনিক টমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯)ইতিহাসে এক অবিস্মরনীয় ব্যক্তিত্ব।রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব দেখিয়েছেন বিশেষ করে মানব প্রকৃতি, প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে।  যা পরবর্তী সময়ের দার্শনিকগনের মানব প্রকৃতি বিশ্লেষণে  ব্যাপক সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।

মানব প্রকৃতি সম্পর্কে হবস এর ধারণা:

সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত দার্শনিক টমাস হবস মানব প্রকৃতি সম্পর্কে যে ধারণা ব্যক্ত করেছেন তা কতটুকু বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ  বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এ বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। নিম্নে হবসের মানব প্রকৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো;

মানুষ নিরাপত্তা প্রত্যাশী: টমাস হবস মনে করেন প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল অত্যন্ত নিঃসঙ্গ, কদর্য ,পশু সদৃশ, ও ক্ষনস্থায়ী যার ফলশ্রুতিতে তারা নিরাপত্তার অনুভব করে এবং নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য পর্যায়ক্রমে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে  মানুষের এই আত্মরক্ষার পদক্ষেপকে টমাস হবস মানুষের সর্বপ্রধান বস্তু হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

মানুষ মূলত জড় পদার্থ: টমাস হবস মানব দেহকে জড়বস্তু সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি বলেন পৃথিবীতে মানুষ ও অন্যান্য বস্তুর ন্যায় একটি জড় পদার্থ।

ক্ষমতা লোভী: মানুষ সব সময় অফুরন্ত ক্ষমতা প্রত্যাশী। মানুষ যে ক্ষমতালোভী এ সম্পর্কে টমাস হবস বলেছেন “মানুষ সবসময়ই ক্ষমতালাভের অবিরাম প্রচেষ্টা চালায় এবং এর সমাপ্তি ঘটে শুধুমাত্র মৃত্যুতে”।

আবেগ দ্বারা পরিচালিত: টমাস হবসের মতে মানুষ জাতি অন্য জীবজন্তুর ন্যায় আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়। মানবজাতি । অন্য সকল পদার্থের ন্যায়  অণু-পরমাণুর সমষ্টিতে তৈরি হয়েছে। মানুষ ও অন্য সব জীবজন্তুর মধ্যে পার্থক্য হল মানুষ যুক্তিবাদী প্রাণী যাদের চিন্তাশক্তিও বাক স্বাধীনতা আছে।

ভালো-মন্দের ধারণা: ভালো-মন্দ সম্পর্কে মানুষের ধারণা আপেক্ষিক। মানুষ  যাকে কামনা করে তাকেই ভালবাসে এবং যাকে খারাপ মনে করে তাকে পরিত্যাগ করার চেষ্টা করে।

বিরামহীনতা : হাপস মনে করেন যে ,মানুষ একটি কর্ম প্রিয় প্রাণী ।জন্মের পর থেকে অবিরাম কাজ করে চলে একটি কাজের সমাপ্তি হলে অন্য কাজ শুরু করে এমনকি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মানুষ কর্মরত থাকে।

কামনা প্রিয় যুক্তি সম্পন্ন:হবসের মতে মানুষ কলহপ্রিয়, স্বার্থপর, লোভী, ঈর্ষাপরায়ন এবং আত্মকেন্দ্রিক সদা সর্বদা নিজের কল্যাণের কামনা করে। এছাড়াও যুক্তির মাধ্যমে শান্তির পথের সন্ধান করতে মানুষ  সর্বদা প্রস্তুত থাকে। আর মানুষের যুক্তিভিত্তিক শান্তির পথের সন্ধান এর জন্যই রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

স্বতন্ত্রবাদী: টমাস হবস বলেন মানুষ স্বতন্ত্রবাদী প্রাণী। প্রতিটি মানুষ অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত না হয়ে নিজস্ব ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত হতে পছন্দ করে।

সম ক্ষমতা সম্পন্ন: হবসের ধারণা মতে ,মানুষের মানুষের কোন পার্থক্য নেই ।কেউ যদি দৈহিক দিক থেকে শক্তিশালী হয় জ্ঞানের দিক থেকে সে দুর্বল আবার কেউ জ্ঞানের দিকে শক্তিশালী হলে দৈহিক দিক থেকে দুর্বল সুতরাং মানুষে মানুষে কোন কোন তারতম্য নেই মানুষ সবাই সমান।

কলহপ্রিয়: মানুষ স্বভাবতই কলহপ্রিয় ঝগড়াটে প্রাণী।টমাস হবস মানুষের এই কলহ প্রিয়তা হওয়ার পিছনে প্রতিযোগিতা ,আত্মবিশ্বাসহীনতা, এবং অহংকার  এই  তিনটি বিষয়কে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও স্বার্থান্বেষী মনোভাব মানুষকে কলহপ্রিয় জাতিতে পরিণত করেছে।

স্বার্থপর: টমাস হবসের মতে, মানুষ মূলত স্বার্থপর  স্বার্থকে কেন্দ্র করে মানুষের যাবতীয় কার্যক্রম ধ্যান ধ্যান ধারণা আবেগ-অনুভূতি পরিচালিত হয়। মানুষ কখনোই নিজ স্বার্থকে বলি দিয়ে অন্যের স্বার্থকে বড় করে দেখতে পছন্দ করেনা।

মানুষ উপযোগবাদী: মানুষ উপযোগবাদী বলতে টমাস হবস বুঝিয়েছিলেন যে ,মানুষ আনন্দ প্রিয় জাতি কিন্তু দুঃখকে গ্রহণ করতে চায় না । মানুষ যে জিনিসের প্রতি অত্যান্ত আকৃষ্ট হয়  তা লাভ করার জন্য বদ্ধপরিকর হয় এবং তা অর্জনে ব্যর্থ হলে দুঃখ অনুভব করে। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে দুঃখের  সঙ্গে মোকাবেলা করতে মানুষ ভয় পায়।

উপসংহার: উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা প্রতীয়মান হয় মানব প্রকৃতি সম্পর্কে টমাস হবসের ধারণা পুরোপুরি যুক্তি যোগ্য না হলেও এটিকে পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য বলা যায় না । কেননা তার এ ধারণা আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তা ধারাকে বিকশিত করতে ব্যাপক সহায়তা করে।

10.প্রশ্ন: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত সামাজিক চুক্তি মতবাদ টি ব্যাখ্যা করো

ভূমিকা: সামাজিক চুক্তি মতবাদ একটি প্রাচীন মতবাদ কিন্তু এ মতবাদের স্বর্ণযুগ হল ষোড়শ সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল বক্তব্য হলো জনগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে।রাষ্ট্রের উৎপত্তি পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বাস করত এবং প্রকৃতির নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হতো ।

চুক্তি মতবাদের সমর্থন: সামাজিক চুক্তি মতবাদ বহু প্রাচীন মতবাদ প্রাচীন গ্রিসে সোফিস্টরা প্রচার করত যে মানুষ চুক্তির মাধ্যমে শক্তিশালী ব্যক্তির হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পণ করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। দার্শনিক সক্রেটিস মৃত্যুর পূর্বে শিষ্যদের বলেছিলেন যে “কারাগার হতে পালিয়ে তিনি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করতে পারেন না”

প্লেটো বলেন যে, প্রকৃতির রাজ্যে ক্ষতির হাত হতে নিজেদের রক্ষা করার জন্য মানুষ পরস্পর চুক্তিবদ্ধ হয় এবং কেউ কারো ক্ষতি করবে না বলে ঘোষণা করে”

প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটলের লেখনীতে ও যুক্তিবাদের কথা উল্লেখ আছে তবে তারা এ মতবাদ কে সমর্থন করেননি । রোমান চিন্তাবিদ পলিবিয়াস এ মতবাদ কে সমর্থন করেন । মধ্যযুগের রোমান আইনে ও সামন্ততন্ত্রে চুক্তি মতবাদের সমর্থন পাওয়া যায় ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রবক্তা গান শাসকের চরম ক্ষমতার বিরুদ্ধে এ মতবাদ কে সমর্থন করেন ।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের চরম বিকাশ ওজর সমর্থন পাওয়া যায় আধুনিককালের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ষোড়শ শতাব্দীর রিচার্ড হুকারের  “Of the Lawes of Ecclesiastical Politie ” নামক গ্রন্থে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হবস এর লেভিয়াথান গ্রন্থে লকের “Two Treatise on Civil Government” নামক গ্রন্থে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি  দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো সমাজ সংস্থা নামক গ্রন্থে তবে সামাজিক চুক্তি মতবাদ লেখনীতে বিশদভাবে আলোচিত হয় এবং সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

সামাজিক চুক্তি মতবাদ সম্পর্কে হবস এর মতামত: হবস ( ১৫৮৮-১৬৭৯) একজন ইংরেজ দার্শনিক। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজাও পার্লামেন্টের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় এর ফলে ইংল্যান্ডের আইন-শৃংখলার ব্যাপক অবনতি ঘটে এসময় 1551 আইন-শৃংখলার প্রতিষ্ঠাকল্পে চরম রাজতন্ত্রকে সমর্থন করে লেভিয়াথান গ্রন্থের রচনা করেন তিনি সামাজিক চুক্তি সম্বন্ধে আলোচনা করেন একজন ধারাবাহিক বৈজ্ঞানিক দার্শনিক হিসেবে তিনি ধাপে ধাপে তার মতবাদের ব্যাখ্যা প্রদান করেন।হবস বলেন যে প্রকৃতির রাজের অসহনীয় অরাজক অবস্থার হাত হতে মুক্তি লাভের প্রেরণায় দ্বিতীয় প্রাকৃতিক আইনের বিধান অনুযায়ী প্রকৃতির রাজ্য সকল মানুষ তাদের যাবতীয় প্রাকৃতিক অধিকার চুক্তির পক্ষে এক ব্যাক্তি ব্যক্তির হাতে সমর্পণ করে দেয় এর মতে সামাজিক চুক্তি সম্পাদিত হয়।

সামাজিক চুক্তি মতবাদ সম্পর্কে জন লকের মতবাদ: জন লক  (১৬৩২-১৭০৪ )একজন ইংরেজি দার্শনিক। ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডের চরম রাজতন্ত্রের অবসান ঘটল এবং রানী মেরী ও রাজার সিংহাসন আরোহণের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র কে সমর্থন পূর্বক ১৬৯০ সালে “Two Treatise on Civil Government” নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন উক্ত গ্রন্থ তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি  মতবাদের ব্যাখ্যা দেন।

লকের মতে, দুটি চুক্তির দ্বারা রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় প্রথম চুক্তি দ্বারা প্রকৃতির রাজ্যের জনসাধারণ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে নিজেদের একটি যৌথ সম্প্রদায় পরিণত করে। এবং প্রাকৃতিক আইনের ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়নের অধিকার তারা এত দিন বিচ্ছিন্নভাবে নিজেরা ভোগ করে আসছিলেন তা এখনও তেরা সম্প্রদায়ের নিকট হস্তান্তর করে একটি সামাজিক চুক্তি নামে খ্যাত ।

দ্বিতীয় চুক্তিটি হলো সরকারি চুক্তি চুক্তি সম্পাদিত হয় সরকার ও জনগণের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী সরকার জনগণের অধিকার ও নিরাপত্তা বিধানের শর্ত দ্বারা পরিচালিত হবে সরকার যদি জনগণের অধিকার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করতে না পারে তাহলে জনগণ ক্ষমতাসীন সরকার পরিবর্তন করে নতুন সরকার গঠন করবে এর নিয়ম তান্ত্রিক দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন।লকের মতে সামাজিক চুক্তি নিঃশর্ত ও চূড়ান্ত ছিল না এ চুক্তির মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রকাশ পেয়েছে।চুক্তির শর্ত অনুযায়ী শাসক বা রাজা জনসাধারনের অধিকার জীবন ও সম্পত্তির জিমিদার মাত্র সরকারগুলো রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে জনগণ নতুন সরকার গঠন করতে পারবে।

জ্যাক রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদ: অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফরাসি দার্শনিক রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদের একজন প্রখ্যাত প্রবক্তা তিনি 1762 সালে দি সোশ্যাল কন্ট্রাকটের  শুরুতেইযে অমর বাণী লিপিবদ্ধ করেছেন তার মধ্য দিয়ে মানবপ্রকৃতির যথার্থ রূপ প্রকাশ পেয়েছে তিনি বলেন মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু সর্বত্র শৃঙ্খলিত উক্তির তাৎপর্য্য হল রাষ্ট্র পূর্ব অবস্থায় মানুষ ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন কিন্তু রাষ্ট্র ও সংস্থার অধীনে মানুষের সেই স্বাধীনতা লাভ পায় প্রকৃতির রাজ্যে মানুষকে তিনি মহান বলে অভিহিত করেছেন তাঁর মতে যুক্তিবাদী তার কারণে নয় বরং আবেগের বশবর্তি হয়ে মানুষের সহযোগিতা ও শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলেন তিনি বলেন প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের মানুষের বন্ধুত্ব সম্প্রীতি পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল তিনি মানুষের স্বার্থপর ও পরশ্রীকাতর হিসেবে দেখেন নি।

রুশোর মতে সামাজিক চুক্তি মতবাদ: রুশো তার বিখ্যাত গ্রন্থ দি সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট এরমধ্যে বলেন যে প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ সাম্য ও স্বাধীনতা ভোগ করতো কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি জনিত সমস্যা কে কেন্দ্র করে সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি হয় অন্তরসমূহ দূর করার লক্ষ্যে জনবিচ্ছিন্ন নতুন শক্তির জন্ম দিয়ে সমস্যা সমাধান হবে না ভেবে প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ সকলে মিলিত সক্ষম হয় এবং সামাজিক চুক্তি সম্পাদিত হয়।

আমরা প্রত্যেকে সমবেতভাবে আমাদের নিজ নিজ জীবন ও সকল ক্ষমতার সাধারণ ইচ্ছার চূড়ান্ত পরিচালনাধীনে ন্যস্ত করি এবং সংঘ বদ্ধ জীবন ব্যবস্থায় আমরা প্রত্যেকে সার্বিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশহিসেবে তা ফিরে পাই” রুশোর সামাজিক চুক্তি বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য গুলো পাওয়া যায়। প্রথমত সকল মানুষ পরস্পর চুক্তির মাধ্যমে সাধারণ ইচ্ছার হাতে সকল ক্ষমতা হস্তান্তর করে এ চুক্তির ফলে একটি যৌথ সংস্থা সৃষ্টি হয় যাকে বডি পলিটিক রিপাবলিক নামে অভিহিত করা হয় । দ্বিতীয়তঃ এ চুক্তির ফলে মানুষের সাম্য ও স্বাধীনতা আপাতদৃষ্টিতে লোপ পায় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র সংস্থার অধীনে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা সং হত হয় এবং অধিক মাত্রায় সংরক্ষিত হয়।তৃতীয়তঃ রুশোর সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

সর্বোপরি সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালোচনা: সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তির সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি বলে বিভিন্ন লেখকের ও চিন্তাবিদ মতবাদকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন।হিন্ডি মেইন সামাজিক চুক্তি মতবাদ কে অসার, গ্রীন একে উপন্যাস, বেন্থাম একে প্রমোদ ধ্বনি, ভলতেয়ার একে বন্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল্যায়ন: সামাজিক চুক্তি মতবাদ কে যেভাবে সমালোচনা করা হোক না কেন এর মতবাদ এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রভাব অনস্বীকার্য।শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনে এবং গণতন্ত্রের উত্তরণের সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রভাব অপরিসীম হবে চরম সার্বভৌমত্ব সমকালীন ইংল্যান্ডের চলমান গৃহযুদ্ধকে অবসান গৃহযুদ্ধের অবসান কে অনেকাংশে প্রশমিত করেছিল দ্বিতীয়তঃ চালশের সিংহাসন আরোহণের ঘটনায় এমন কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় চুক্তি মতবাদ ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র তথা রাজা ও রানীর সিংহাসন আরোহণের প্রতি সমর্থন দান করে এর প্রভাবে 1789 সালে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং ফ্রান্সে গণতন্ত্রের সূচনা ঘটে ফরাসি বিপ্লবের পরে জাতীয় বীরের মর্যাদায় জাতীয় সমাধি ক্ষেত্রের সমাধিস্থ করা হয় সুতরাং সামাজিক চুক্তি মতবাদের গুরুত্বপূর্ণ বহুল বিভিন্নমুখী।

উপসংহার: উপযুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদ টি একটি যুক্তিযুক্ত মতবাদ। রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পেছনে সামাজিক চুক্তি মতবাদ কি একটি গ্রহণযোগ্য এবং সার্বজনীন স্বীকৃত মতবাদ।

11.স্বাধীনতার রক্ষাকবচ সমূহ আলোচনা করো।

ভূমিকা: স্বাধীনতা হল অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের অধিকার পরিপূর্ণ ভাবে ভোগ করা। স্বাধীনতা হল একটি শর্ত, যেখানে একটি জাতি, দেশ বা রাষ্ট্র বা জায়গা যেখানে থাকবে জনগণ, থাকবে নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা এবং সাধারণত কোন অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব। স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়।

স্বাধীনতার কিছু গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ নিম্নে আলোচনা করা হল:

 আইন: আইন স্বাধীনতার শর্ত ও রক্ষক। আইন আছে বলেই স্বাধীনতা ভোগ করা যায়। কোন ব্যাক্তি বিশেষের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হলে আইন দ্বারা তার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা যায়। আইন বিহীন সমাজে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার চিত্র মাত্র। জন লকের মতে, “যেখানে নেই সেখানে স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতে পারে না।”

গণতন্ত্র: গণতন্ত্র  স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় জনমতের ভিত্তিতে সরকার নির্বাচিত হয়। ফলে সরকারকে সব সময় জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে হয় তাদের কর্মের জন্য। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর ফলে ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার জনগণের অধিকারের প্রতি যত্নশীল থাকে। এতে করে ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা পায়।

মৌলিক অধিকার: সংবিধানে উল্লেখিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার স্বাধীনতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ  রক্ষাকবচ। জনগণের মৌলিক অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হলে তার সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা লাভ করে এবং এ সম্পর্কে জনগণ সুস্পষ্ট ধারণা পায়। ফলে তাদের অধিকার ক্ষুন্ন করা হচ্ছে কিনা তা সম্পর্কে তারা জানতে পারে। যদি কোন সরকার অথবা কায়েমি স্বার্থবাদী মহল তাদের অধিকার নষ্ট করার চেষ্টা করে,তাহলে তারা তার ব্যবস্থা নিতে পারে।

দায়িত্বশীল সরকার: দায়িত্বশীল সরকারকে আমরা স্বাধীনতার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এরূপ শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলের সমালোচনার ভয়ে সরকার স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে না।

আইনের শাসন: আইনের শাসন বলতে আমরা বুঝি আইনের প্রাধান্য জাতি,বর্ণ,ধর্ম নির্বিশেষে আইন সকলের জন্যই সমান থাকবে। কাউকে বিনাবিচারে গ্রেপ্তার করা যাবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা আইনের শাসনের অন্যতম শর্ত। যে সমাজে আইনের শাসন নিশ্চিত হয়, সেখানে স্বাধীনতা পূর্ণরূপে বিরাজ করে।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ: সরকারের মূল তিনটি বিভাগের স্বাধীনতা ও পারস্পারিক  স্বতন্ত্র ই হল ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ। একই ব্যক্তি অথবা বিভাগের নিকট সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না করে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ অত্যাবশ্যক। মন্টেস্কু ব্যাক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য  ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচার বিভাগ ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করে। আর বিচার বিভাগকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হলে অবশ্যই আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হতে হবে। যদি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা পায়, তাহলে জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা পাবে এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

শিক্ষার হার বৃদ্ধি: ব্যক্তিকে তার স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য প্রথমত শিক্ষিত হতে হবে। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত ও স্বাধীন।তাই স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে শিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে হবে।

জনগণের সতর্ক দৃষ্টি: জনগণের সতর্ক দৃষ্টি সারা স্বাধীনতা রক্ষা পায় না। জনগণ তাদের স্বাধীনতা সম্পর্কে অচেতন হলে যেকোনো সরকার অথবা স্বার্থন্বেষী মহল তাদের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে। তাই অধ্যাপক বলেছেন, “চিরন্তন সতর্কতার মধ্যেই স্বাধীনতার মূল্য নেই।”

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: জাতীর অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হলে অর্থের যোগান দিতে তারা তাদের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয় অথবা অন্য মহল তাদের স্বাধীনতাকে খর্ব করে অর্থের বিনিময়ে। তাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি স্বাধীনতা রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা একটি জাতিকে স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ দিতে পারে।

উপসংহার: স্বাধীনতার সভ্য সমাজের অপরিহার্য উপাদান এবং মানুষের চিরন্তন অধিকার। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে রাষ্ট্র তার জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারে। সুতরাং, স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য সরকারকে যেমন তৎপর হতে হবে ঠিক তেমনি জনগণকে সচেতন হতে হবে।

12.প্রশ্ন: রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব বর্ণনা করো।

ভূমিকা:  প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশোর (১৭১২- ১৭৭৮) সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব টি রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর সহজ ধারণা লাভ করা কঠিন। তবে সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব না জানিলে অন্যসকল ধারণা অনুধাবন করা যাবে না।

সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা: সাধারণ ইচ্ছা হল একটি কল্যাণকর ইচ্ছার মধ্যে সকলের স্বার্থ জড়িত থাকে । এটা কোন সময় ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবেনা । সাধারণের ইচ্ছা মানে যে সকলের ইচ্ছা হবে এমন কোন কথা নয় ।  সকলের ইচ্ছার অর্থ প্রত্যেক ব্যক্তির ইচ্ছার সমষ্টি মাত্র সেটা কল্যাণকর হতে পারে নাও পারে । সেখানে ব্যক্তি বা ব্যক্তি স্বার্থের কথা লুকায়িত থাকতে পারে । যেখানে ব্যক্তিস্বার্থের প্রসঙ্গ থাকবে সেটা সাধারণ ইচ্ছা হবে না। আবার  সংখ্যাগরিষ্ঠ ইচ্ছা হলে সাধারণের ইচ্ছা হবে না কেননা তার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস থাকতে পারে এখানে সর্বসাধারণের মঙ্গলের কথা নাও থাকতে পারে অন্যদিকে একজন ব্যক্তির ইচ্ছা যদি সকলের কল্যাণকারী হয় তবে তা সাধারণের ইচ্ছায়  পরিণত হতে পারে।

সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের বিশ্লেষণ: ফরাসি দার্শনিক রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব টি জটিল এবং বোঝা কষ্টসাধ্য। নানাভাবে একে সহজবোধ্য করার চেষ্টা করেছেন। তিনি সাধারণ ইচ্ছা আলোচনা করতে গিয়ে তিনি সাধারণ ইচ্ছার মধ্যে আরো দুইটি শ্রেণীবিভাগ দেখিয়েছেন সেগুলো হলো প্রকৃত ইচ্ছা এবং বাস্তব ইচ্ছা। প্রকৃত ইচ্ছা হল ব্যক্তির একান্ত আত্ম সম্পর্কিত ইচ্ছা, এর মধ্যে শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস লুকায়িত থাকে এবং সাধারণের কথা ভাবা হয় না। অন্যদিকে বাস্তবতা হলো কল্যাণকামী এবং তাতে ব্যক্তির ক্ষতির কোন লক্ষণ নিয়োজিত থাকে না বাস্তবে ব্যক্তির নিজের এবং অন্য সকলের কল্যাণ নিহিত থাকে। বাস্তবতার সাথে মনুষ্যত্ব বিজড়িত এবং তা কোন সময়ে অকল্যাণকামী হতে পারে না। সুতরাং বলা যায় যে প্রকৃত ইচ্ছা হল আত্মকেন্দ্রিক ক্ষণস্থায়ী ভাবপ্রবণ ও অযৌক্তিক। কিন্তু বাস্তব ইচ্ছা আবেগহীন সমষ্টিগত যুক্তিভিত্তিক স্থায়ী এবং কল্যাণকামী।রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব টিরবৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় এগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।

অবিভাজ্যতা: সাধারণ ইচ্ছা ঐক্যের প্রতীক এবং তাকে বিভাজন করা যাবে না। বিভাজ্য হলে সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এটা একটি সদিচ্ছার সমাহার তাই একে বিভাজ্য করা যায় না।

স্থায়িত্ব: এটা একটি স্থায়ী ইচ্ছা কোন সময়ে এর কার্য প্রক্রিয়া শেষ হয় না এটা যুক্তিনির্ভর তাই আবেগ তাড়াতাড়ি তো হয় না এবং সে কারণেই স্থায়ী হয়।

সামগ্রিক মঙ্গল: সাধারণ ইচ্ছার মধ্যে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের কথা উল্লেখ থাকে যা সমষ্টির কল্যাণে নিবেদিত হয়না তা সাধারণের ইচ্ছা নয় এক কথায় বলতে গেলে রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব টির মূল কথা হলো সামগ্রিক কল্যাণ সাধন করা।

নৈতিকতা পূর্ণ: সাধারণ ইচ্ছা ধারার সমষ্টি গত মঙ্গল হয় সত্য কিন্তু সাথে সাথে তাকে হতে হবে নৈতিকতা পূর্ণ। সাধারণ ইচ্ছা কখনোই নৈতিকতা বিরোধী হবে না। সাধারণ ইচ্ছাকে নৈতিকতার মানদন্ড পরিমাপ করা হয়।

যুক্তিনির্ভর: রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব টি একটি যুক্তিনির্ভর তত্ত্ব। সাধারণের ইচ্ছা অযৌক্তিক কোন আবেগপূর্ণ ধারণা বা কামনা বাসনাকে প্রশ্রয় দেয় না এরমধ্যে জোরালো যুক্তিগত কল্যাণকামী উদ্দেশ্য থাকে।

হস্তান্তর যোগ্য নয়: রুশো সাধারণ ইচ্ছাকে সার্বভৌমত্বের সাথে তুলনা করেছেন সুতরাং সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব কে হস্তান্তর করা যায়না।

গণতান্ত্রিক: সাধারণ ইচ্ছা  তত্ত্বে রুশো তার গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। গণতন্ত্রের যেমন যুক্তির ভিত্তিতে একজনের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয় তেমনি রুশো তার সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের বলেছেন যে একজনের মত সাধারন ইচ্ছায় পরিণত হতে পারে যদি তার ইচ্ছা জনকল্যাণকর হয়।তাছাড়া জনগণের প্রাধান্য কে সমুন্নত রাখার জন্যই তার সাধারন ইচ্ছা তত্ত্বটি ব্যক্ত করেছেন।

রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের সমালোচনা: প্রতিটি রাজনৈতিক দর্শনের যেমন ভালো দিক রয়েছে তেমনি এর কিছু নেতিবাচক দিক পরিলক্ষিত হয়। রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ দের প্রশংসা কুড়িয়েছেন ঠিক তেমনি কিছু কিছু রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এর কিছু নেতিবাচক দিক তুলে ধরেছেন সেগুলো নিচে আলোকপাত করা হলো।

অস্পষ্টতা: সাধারণ ইচ্ছা কোনো সুস্পষ্ট মতবাদ নয় যাতে সাধারণের কল্যাণ হয় তাকেই সাধারণের ইচ্ছা বলা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে কোন অবস্থায় তা পাওয়া যাবে তার কোন প্রমাণ নেই।কোন সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে বলা হয়েছে সাধারণ ইচ্ছা আবার কোন সময় একজনের মত কেউ সাধারণ ইচ্ছা বলে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব টি অস্পষ্টতায় জড়িত।

ব্যক্তির স্বাধীনতাহীন: সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব টি তে জনগণের কল্যাণের কথা বলা হলেও এখানে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা উল্লেখ নেই। ব্যক্তির সমগ্র ক্ষমতা সাধারণ ইচ্ছা নিকট সমর্পণ করে এবং সাধারণ ইচ্ছা করতেছে এককভাবে শাসন করতে পারে এতে প্রমাণিত হয় যে ব্যক্তির কোন স্বাধীনতা নেই।

জনস্বার্থ রক্ষা: জনস্বার্থ রক্ষার্থে বললেও এতে কিভাবে তা রক্ষিত হয় সে কথা বলা নেই।

অপ্রতিনিধিত্বমূলক: সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের চিন্তা করা হয়নি এখানে জনগণই যেন জনগণের প্রতিনিধি ।রকম  মতামত প্রতিনিধিত্বকর গণতন্ত্রে লক্ষ্য করা যায়।  কিন্তু রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব টি সম্পূর্ণ অপ্রতিনিধিত্বমূলক।

আন্তর্জাতিক মান: সাধারণ ইচ্ছার কোন আন্তর্জাতিক মানদন্ড নেই। কিন্তু থাকা আবশ্যক রাষ্ট্র কোন অন্যায় করতে পারে না। এমন ধারণার ওপর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বেলায়ও রাষ্ট্রের নৈতিক মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিতে গেলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার ওপর হস্তক্ষেপ করা  হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব টি একটি কল্পনাবিলাসী তত্ত্ব।তবে আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাব যে তিনি বাস্তবে সাধারণের মঙ্গলের কথাকে সামনে রেখেই তার সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব টি প্রণয়ন করেছিলেন।

13.ম্যাকিয়াভেলিবাদ কী? ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন?

ভূমিকা: পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে যেসব রাষ্ট্রচিন্তাবিদ তাদের লেখনি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি অন্যতম। নিকোলো মেকিয়াভেলি কে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কারণ তিনি রাষ্ট্রচিন্তা কে মধ্যযুগীয় সীমানা থেকে আধুনিক যুগের নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্য তাকে মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের সেতুবন্ধন কারি বলা হয়।

ম্যাকিয়াভেলিবাদ: ম্যাকিয়াভেলি হল সর্বপ্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ যিনি তাঁর চিন্তা ধারা দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে মধ্যযুগের গন্ডি থেকে আধুনিকতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। মেকিয়াভেলিবাদ সাধারণত কারো অনুসৃত পদ বা মন্তব্য কে বাদ বলা হয়। যেমন লেলিনবাদ মার্কসবাদ ইত্যাদি।তদ্র ম্যাকিয়াভেলির মন্তব্যকে ম্যাকিয়াভেলিবাদ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তিনি শাসককে রাষ্ট্রশাসনের নিমিত্তে স্নেহ-ভালোবাসা প্রেম-প্রীতির ঊর্ধ্বে অবস্থান করতে পরামর্শ দিয়েছেন। শাসক দরকার বস তা-ও নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়ে শাসন করবেন, যেন মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। রাষ্ট্র শাসন ব্যাপারে নৈতিকতা ও ধর্মীয় বিধানের কোন স্থান নেই। রাষ্ট্র শাসন করতে গিয়ে অনৈতিক ও ধর্মহীন ব্যবস্থাও নিতে পারবেন। রাষ্ট্র শাসন করতে গিয়ে তিনি এ ধরনের যেসব যেসব মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে তাই ম্যাকিয়াভেলিবাদ নামে পরিচিত।এটি একটি খারাপ মতবাদ হিসেবে ও সমালোচিত হলেও তৎকালীন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এসব কথা বলতে হয়েছিল। কোন রাষ্ট্রকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য এ মতবাদের বিকল্প কিছু হয় না। ধ্বংসপ্রাপ্ত ইতালিকে রক্ষার জন্য এটা ছিল যুগোপযোগী মতবাদ। ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কারণ : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মেকিয়াভেলি যে অবদান রেখেছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিতেই তাকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা: নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি একজন ইতালি ও দার্শনিক ও রাষ্ট্র চিন্তাবিদ। তিনি সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তৎকালীন ইতালিকে ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রকে ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করে একটি মানবীয় প্রতিষ্ঠান রূপে প্রতিষ্ঠা করতে প্রচেষ্টা করেছিলেন।

বাস্তববাদী ধারণার প্রবক্তা: ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন বাস্তববাদী রাষ্ট্র চিন্তাবিদ ও দার্শনিক তার রাষ্ট্র দর্শন ছিল ছলচাতুরি এবং অসত্য থেকে মুক্ত। তার সময়ে ইউরোপের অবস্থাকে তিনি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তার এই পর্যবেক্ষণের আলোকে আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি তার লেখনীর মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। তার সম্পর্কে অধ্যাপক গেটেল বলেন, “ম্যাকিয়াভেলি রাজনৈতিক তত্ত্ব কে বাস্তবতার সংস্পর্শে আনেন কেননা ম্যাকিয়াভেলি সবক্ষেত্রেই বাস্তব ঘটনা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যস্ত ছিলেন।”

ধর্মনিরপেক্ষতা: ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা তিনি প্রথমে উল্লেখ করেন। যা আধুনিক রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে।সম্পূর্ণরূপে ধর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত করার কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন। সুতরাং তার লেখনীর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

রাষ্ট্রের যুক্তি: রাষ্ট্রের যুক্তিকে সব যুক্তির উপরে স্থান দেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি।রাষ্ট্রের জন্য দরকার ক্ষমতার । ক্ষমতার প্রতি তিনি বিশেষ নজর রাখেন। তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ধর্ম ও নৈতিকতার ঊর্ধ্বে স্থান দেন এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে তিনি ইতালির শক্তিই মূলত সুসংহত করতে চেয়ে ছিলেন।

জাতীয় রাষ্ট্রের মতবাদ: ম্যাকিয়াভেলি প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ  যিনি জাতীয় রাষ্ট্র ও জাতীয়তা বোধের প্রয়োজন অনুভব করেন।যে কোন রাষ্ট্রকে শক্তিবান ও ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করতে হলে জাতীয়তা বোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। নিজ দেশ ইটালির বাস্তব অবস্থা দর্শনে তিনি এরূপ মতবাদ প্রচার করেন।

কূটনৈতিক যুক্তি: ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেন, শাসক কে শৃগালের নেয় ধূর্ত এবং সিংহের ন্যায় তেজস্বী হতে হবে”। তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের কথার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আধুনিক রাষ্ট্রের প্রবর্তক:পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা বিএড যেমন প্লেটো এরিস্টটল কিংবা কাল মার্কসের মতে মেকিয়াভেলি রাষ্ট্রতত্ত্বের উদ্ভাবন করেন নি কিন্তু তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্র সৃষ্টি নিয়ামক গুলো উপস্থাপন করেছিলেন। যা একটি আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য।তার রাষ্ট্র সম্পর্কিত মতবাদ পরবর্তীকালে আধুনিক দার্শনিকদের যেমন হবস লক বেন্থাম অস্টিন এদের মত রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এর প্রভাবিত করেছে।

মানব চরিত্র অংকন: ম্যাকিয়াভেলি তার মতবাদ এর মাধ্যমে মানব চরিত্র কে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।বাস্তবতার আলোকে তিনি মানুষকে মন্তব্য করেছেন স্বার্থপর লোভী হিংসুক ও চরিত্রহীন বলে। এছাড়াও তিনি আরো বলেন, মানুষ তার পিতৃ হত্যাকারিকে সহজে ক্ষমা করতে পারে কিন্তু পৈত্রিক সম্পত্তি হরণকারী ক্ষমা করতে পারে না।” এখানে ম্যাকিয়াভেলি মানুষের স্বার্থপর এবং লোভী চরিত্রটির প্রতিকৃতি অংকন করেছেন।

মধ্যযুগীয় ধারণার অবসান: মধ্যযুগের রাজনীতি ছিল ধর্মনির্ভর এবং নৈতিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ। গির্জা ছিল রাষ্টের নীতি নির্ধারক। যার ফলে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হতো এবং এই দ্বন্দ্ব নিরসনের পথ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হত। ম্যাকিয়াভেলি এইরূপ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে তার দর্শন স্থাপন করেন যে রাষ্ট্র হল একটি মানবীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের সম্পূর্ণ আলাদা।তাই ধর্মের দোহাই দিয়ে মধ্যযুগের ধর্মযাজক গঞ্জে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করছে তার বিরোধিতা করেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। এভাবে তিনি মধ্যযুগীয় রাজনীতির অবসান ঘটানো এবং আধুনিক রাষ্ট্রের জনক হিসেবে আবির্ভূত হন।

উপসংহার :উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাষ্ট্রচিন্তায় আধুনিকতার দ্বার উন্মুক্ত করেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। যার মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তী রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ আধুনিক রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন করেন।

14.প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব টি আলোচনা করো।

ভূমিকা: রাষ্ট্র চিন্তাবিদদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাণপুরুষ হিসেবে অভিহিত করা হয় তাদের মতামতের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এর মধ্যে প্লেটো ছিল অন্যতম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম পুরুষ হিসেবেও প্লেটো কে বিবেচনা করা হয় তার ন্যায়বিচার তত্ত্ব টি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে একটি প্রশংসনীয় এবং সার্বজনীন গৃহীত একটি তত্ত্ব। নিচে গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো। এমনকি দি রিপাবলিক গ্রন্থের বিকল্প নাম হলো ন্যায় বিচার বিষয়ক গ্রন্থ। অধ্যাপক স্যাবাইন বলেন, দি রিপাবলিক এর ন্যায়বিচার তত্ত্বের মধ্য দিয়ে প্লেটোর রাষ্ট্রীয় মতবাদ চূড়ান্ত দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে।

ন্যায়বিচার তত্ত্ব: প্রখ্যাত গ্রন্থ দি রিপাবলিক এর মধ্যে ন্যায়বিচার তত্ত্ব আলোচনা করেছেন প্লেটো। এটি হলো জীবনের পরিনিত বিষয়ে রচনা এর মধ্যে রয়েছে ইতিহাস রাষ্ট্র দর্শন ভূগোল সংগীত অংক ধর্ষণসহ নানা বিষয়ে আলোচনা তেমনি এই রিপাবলিক গ্রন্থ কে জ্ঞানের বিশ্বকোষ বলা হয়ে থাকে। আর এই গ্রন্থের মধ্যেই প্লেটো তার ন্যায়বিচার তত্ত্ব টি আলোচনা করেছেন।

প্লেটোর ভাষায় ন্যায় বিচার হল কর্ম বিশেষীকরণ এর মাধ্যমে কর্মবন্টন ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ দেওয়া এবং এভাবে পারস্পারিক সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা কে ন্যায়বিচার বলা হয়। অর্থাৎ ন্যায়-বিচার বলতে সাধারণত যার যে যোগ্যতা রয়েছেসে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ দেওয়াই হল ন্যায় বিচার আর এভাবেই সরকার ও জনগণের মধ্যে সুষ্ঠু সম্পর্ক বিদ্যমান থাকবে।

প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব টি বিভিন্ন বাস্তবিক বৈশিষ্ট্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো।

সামাজিক বন্ধন: ন্যায়বিচার হল একটি সামাজিক বন্ধন এর দ্বারা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে সুশৃংখল রূপে পরিচালনা করে নির্দিষ্ট পথে নেওয়া যায়।

ব্যক্তির নির্দিষ্ট স্থান: এই সামাজিক বন্ধন ব্যক্তিকে সমাজ তথা রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট স্থান প্রদান করে নির্দিষ্ট স্থানে নির্ধারিত হয় শিক্ষা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে।

ব্যক্তি ও রাষ্ট্র একই: প্লেটোর ন্যায় ধর্মতত্ত্ব পর্যালোচনা করলে বাস্তবে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোন পার্থক্য সীমারেখা দেখা যায়না ব্যক্তি মাত্র দুই ক্ষেত্রেই অনুরূপ ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে।

ব্যক্তির যোগ্যতা বৃদ্ধি: আপাতত দৃষ্টিতে মনে হবে ব্যবস্থাটির দ্বারা ব্যক্তির যোগ্যতাকে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আবদ্ধ করা হয়েছে এবং তা দ্বারা চারিত্রিক বিকাশ সম্ভব হবে না ।বাস্তবে কিন্তু তা নয়। চারিত্রিক বিকাশের না হয়ে বরং সঠিকরূপে পরিস্ফুটিত হতে পারবে , কেননা একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে ব্যক্তি মানুষকে যোগ্যতাসম্পন্ন করে তোলার প্রয়াস চালানো হয়েছে।

সৎ নাগরিক সৃষ্টি: রাষ্ট্র হল মানব জীবনের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান । ব্যক্তির নৈতিক জীবনের সাথে রাষ্ট্রের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ন্যায় বিচারের দ্বারা একজন মানুষ যেমন যোগ্য নাগরিক হতে পারে তেমনি সৎ মানুষ হতে পারে।

যোগ্যতার নাগরিকের জন্ম: প্লেটোর ন্যায় বিচারের কার্যকারী দিকটি হলো যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি করা।ন্যায় বিচারের প্রকৃত অর্থ যোগ্যতা অনুসারে দায়িত্ব পালন করা।সুতরাং একজন ব্যক্তি যদি তার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পায় তাহলে সে একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে।

আত্মনিয়ন্ত্রণ: ন্যায়বিচার তত্ত্ব ব্যক্তিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দেয়। যে যেই বিষয়ে যোগ্যতা বান সে সেই বিষয়ে কাজ কেবল সম্পাদন করবে, অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।

স্বার্থপরতা শিক্ষা দেয় না: ন্যায় ধর্মতত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে অনুধাবন করা যায় যে, ব্যক্তি যে দায়িত্ব পালনে পারদর্শী শুধু সেটাই করবে, অন্য কিছু নয় । এতে মানুষ পরশ্রীকাতর হয় না।

প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বের সমালোচনা: প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব টি যেমন তাকে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে ঠিক তেমনি তার এই ন্যায়বিচার তত্ত্ব টি কিছু রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এর দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।

রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি: এই তত্ত্বে প্লেটো ব্যক্তির ক্ষমতা অসম্ভব রূপে খর্ব করা হয়েছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং অনেক সময় ব্যক্তির ক্ষমতা অবজ্ঞা করা হয়েছে।

সর্বাত্মকবাদের সৃষ্টি: আধুনিক যুগে সর্বাত্মকবাদ বলতে যা বোঝানো হয়েছে তার সূত্রপাত হয় না ধর্মতত্ত্বে।সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে ব্যক্তির ইচ্ছার কোন মূল্য দেওয়া হয়নি।ঠিক তেমনই নয় ধর্ম তত্ত্বেও রাষ্ট্রের মতামতকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এখানে ব্যক্তির মতামতের কোনো মূল্য নেই।

শাসকশ্রেণীর একচেটিয়া ক্ষমতা: রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীকে একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ এর লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে কিন্তু কোন শ্রেণীকে একচেটিয়া ক্ষমতা দিয়ে বিশ্বাস করা যায় না।

গণতন্ত্রবিরোধী: গণতান্ত্রিক ধারণা ও মূল্যবোধের সাথে এর কোনও সামঞ্জস্যতা নেই , কেননা এখানে সে বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হয়নি।

শ্রেণীগত শাসন: প্লেটো শ্রেণী শাসন প্রবর্তনের চিন্তাভাবনা অংকন করেছিলেন তার ন্যায় বিচার তত্ত্বের মাধ্যমে। অনেকেই মনে করেন যে, তিনি যেহেতু অভিজাত ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন তাই এক বিশেষ শ্রেনীর শাসনের কথায় তিনি তার ন্যায়বিচার তত্ত্ব উল্লেখ করেছেন।

অবাস্তব: ন্যায় বিচারের মূলকথা হলো কেউ কারো কাজে হস্তক্ষেপ করবে না অথচ বাস্তবে কিন্তু তা সম্ভব নয় শাসক শ্রেণী অন্য শ্রেণির কাজ তদারক করতে বাধ্য থাকবে এবং এটা তাদের দায়িত্বের আওতাভুক্ত।

উপসংহার :ন্যায় বিচারতত্ত্বের অনেক সমালোচনা থাকলেও এর যে বহু প্রশংসনীয় দিক আছে তা অস্বীকার করা যাবে না। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তিনি আদর্শ রাষ্ট্র কার্যকরী করতে  চেয়ে ছিলেন যেখানে সকল শ্রেণীর মানুষ আদর্শ জীবন যাপন করতে সক্ষম হবে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman
Articles: 403

Leave a Reply