একজন বুদ্ধিজীবীর কেমন হওয়া উচিত এবং দেশের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য ও দেশের মানুষ তার কাছ থেকে কি আশা করতে পারে এই সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে আমেরিকান স্কলার এসে তে।
এসে অর্থাৎ এই রচনাটির লেখক এমারসন । আমরা সবাই জানি যে এমারসন পেশায় একজন রাজকীয় যাজক ছিলেন। কিন্তু তিনি একসময় ভাবতে লাগলেন যে এই রাজকীয় কাজকারবার এবং আরাম আয়েশের মধ্যে থেকে পৃথিবীর মানুষদের সমস্যাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়।
তাই তিনি এই পথ থেকে ইস্তফা দিয়ে ইউরোপ জুড়ে ভ্রমণ করতে লাগলেন এবং জ্ঞান অর্জন করতে লাগলেন। সবশেষে ১৮৩১ সালে তিনি একজন পাবলিক স্পিকার হিসেবে তার ক্যারিয়ার গড়ে তুললেন।
১৮৩৭ সালে ফি বেটা কাপ্পা নামক একটি প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে বক্তব্য দেওয়ার জন্য তাকে ইনভাইট করে। তারা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন এবং সেখানে এমারসন একটি বক্তব্য দিল যা সারা পৃথিবী জুড়ে ঝড় তুলে দিল।
More: The functions of books, according to Emerson
পৃথিবীর বুদ্ধিজীবীরা মনে মনে ভাবছিলেন এবং সমালোচনা করছিলেন যে এই বক্তৃতা হয়তো আমেরিকার স্বাধীনতার একটি পরোক্ষ ঘোষণা। এটাকে অনেকে সিঙ্গার ফু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন যার মাধ্যমে মনে করা হয় যে আমেরিকার স্কলাররা নতুনভাবে এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করার একটি প্রয়াস করছেন।
এমারসন তার এই বক্তব্য দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন যে আমেরিকার একজন স্কলার বা বুদ্ধিজীবী কেমন হতে পারে, তিনি কিসের কিসের দ্বারা প্রবাহিত হতে পারেন এবং জাতি তাদের কাছ থেকে কি আশা করতে পারে এসব সম্পর্কে।
শুরুতেই তিনি তিনটি বিষয়ের কথা বলেছেন যার মাধ্যমে স্কলাররা প্রভাবিত হতে পারে যেগুলো হচ্ছে ন্যাচার বা হিউম্যান সোল, বই এবং একশন।
এমারসন তার বক্তৃতা উল্লেখ করেছেন এক সুইডিস ফিলোসফারের কথা যিনি বলেছেন যে আসলে প্রকৃতি ও মানব আত্মা দেখতে বা ভাবতে ভিন্ন মনে হলেও দুইটা একই জিনিস। দুইটাই সেকুলার প্রসেস অবলম্বন করে ঘুরতে থাকে।
আসলে এমারসন বোঝাতে চেয়েছেন যে মানব আত্মা দ্বারা একজন বুদ্ধিজীবী সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে। সে বই পড়বে এবং জ্ঞান অর্জন করবে ঠিকই কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে তার নিজের আত্মা দ্বারা এবং নিজের চিন্তাধারা দ্বারা।
এখানে এমারসন দুই ধরনের চিন্তাধারার বর্ণনা করেছেন যার একটি হচ্ছে মেন থিংকিং এবং আরেকটি হচ্ছে মেয়ার থিংকিং। মেন থিংকিং বলতে তিনি বুঝিয়েছেন নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা এমন সব চিন্তাধারা যা পৃথিবীর মানুষদের জন্য কল্যাণকর হবে এবং কার্যকরী হবে।
আর মেয়ার থিংকিং বলতে বোঝানো হয়েছে এমন সব চিন্তাধারাগুলোকে যেগুলো মানুষের জন্য কল্যাণকর হতেও পারে নাও হতে পারে। সেটা হতে পারে বই পড়ে যে কোন কিছু সরাসরি বই থেকে রেফারেন্স দেওয়া। এখানে নিজের কোন অভিমত কিংবা চিন্তাধারা থাকবে না।
এ বিষয়টি সম্পর্কে আরেকটু পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় চলুন। মনে করেন আমাদের সমাজের কোন এক ব্যক্তি এমন কিছু কাজ করতো যা সমাজের এবং দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আর এর একটা কারণ হতে পারে সে ওই কাজটা সম্পর্কে জানতো না বা সচেতন ছিল না। কিন্তু ম্যান থিংকিং এর মাধ্যমে কোন মানুষ যদি নিজেকে develop করে তবে সেক্ষেত্রে তিনি অচেতন থেকে সচেতনতার পর্যায়ে চলে যাবেন এবং নিজে নিজেই বুঝতে পারবেন যে দেশের মানুষ ও সমাজের জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ
এক্ষেত্রে তিনি যে ক্ষতিকর কাজটি আগে করতেন তা এখন আর করবেন না যেটাকে action হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
এমারসন ঠিক এই বিষয়টি আমেরিকান স্কলার এ তুলে ধরেছেন যে যারা আমেরিকার বিখ্যাত স্কলার হবে তারা শুধু বইপোকা হবে না। তাদের চেহারা লীগ লেখা হবে না এবং তারা এটা মনে করতে পারবে না যে তাদের কাজই হবে শুধু ঘরের ভেতরে থেকে বই পড়া এবং জ্ঞান অর্জন করা।
বরং আমেরিকান স্কলাররা হবে শক্ত এবং সামর্থ্যবান বলিষ্ঠ চেহারার অধিকারী যাদের প্রত্যেকটি কাজকর্ম ও সিদ্ধান্ত হবে যুগান্তকারী এবং এটি মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। এভাবেই আমেরিকান স্কলাররা সারা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাপিয়ে বেড়াবে।
More: Self-trust and individualism in The American Scholar
একটা বিষয় ভাবলে অবাক লাগে যে এমারসন এই বিষয়টি বলেছিলেন ১৮৩৭ সালে কিন্তু আজকের পৃথিবীতে আমরা দেখতে পাই পৃথিবীজুড়ে আমেরিকা আসলেই রাজত্ব করছে।
এমারসন আরো একটি বিষয় খুব সুন্দর ভাবে বলেছেন যে এই পৃথিবীতে তারাই রাজত্ব করতে পারবে যারা সারা পৃথিবীর বিষয়বস্তুগুলো নিজেদের মতো করে রং চড়িয়ে রাঙ্গাতে পারবে এবং বর্ণনা করতে পারবে। আমরা কিন্তু আজকে সেটাই দেখতে পাচ্ছি যে আমেরিকা পৃথিবীর বেশিরভাগ বিষয়বস্তুগুলোতে নিজেদের মতো করে রঙ চড়িয়ে নিজেদের আবিষ্কারের মাধ্যমে পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
এমারসনের মতে আমেরিকান স্কলারদের অবসরের সঙ্গী হবে বই। তারা তাদের অবসর সময়ে প্রচুর পরিমাণে বই পড়বেন এবং সেখান থেকে জ্ঞান অর্জন করবেন। তিনি বলেছেন যখন স্কলাররা চিন্তাশক্তি হারাবে তখন তারা কাজ করবে তাদের কর্মদক্ষতার মাধ্যমে। আজকে যেটা কাজ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে আগামী কালকে সেটা কনসেপ্ট হিসেবে পৃথিবীর বুকে পরিচিত হবে।
এখানে কাজ এবং কনসেপ্টের যে সম্পর্ক সেটা এমারসন সুন্দরভাবে ডেভলপ করেছেন। হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটির যে সোসাইটি এই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিলেন সেখানে এমারসনের দেওয়া বক্তব্যের কারণে এটা মনে করা হয় যে তিনি সেই সময়েই গণজাগরণের ডাক দিয়েছেন।
তিনি স্কলারদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে আমেরিকান স্কলাররা শুধুমাত্র চিন্তা ভাবনায় সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং তারা তাদের চিন্তাভাবনার পাশাপাশি সেগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেটা নিয়েও অগ্রসর হবেন।
এমারসন আরো একটি ধারনার উদ্ভব ঘটিয়েছেন যেটা হল পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ আলাদা হলেও তারা একটি নির্দিষ্ট সত্তার জন্য কাজ করে থাকে এবং সেটাই করা উচিত। এখানে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায় যে একজন মানুষের হাত-পা নাক কান চোখ এগুলো ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে থাকলেও সবাই কিন্তু সেই নির্দিষ্ট মানুষটির জন্যই কাজ করে।
ঠিক একই ভাবে একটি সমাজে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার চিকিৎসক প্রফেসর শিক্ষক উকিল এবং আরো বিভিন্ন পেশার মানুষ বসবাস করতে পারে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে তারা একটা নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের জন্য কাজ করছে এবং তাদের সেটাই করা উচিত। তাহলেই শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন কল্পনা করা সম্ভব।
আর এটাই হচ্ছে মেন থিংকিং কনসেপ্ট।
এরপর এমারসন তার বক্তৃতায় বলেছেন যে আমেরিকান স্কলারদের কার্যকারিতা বা কার্যক্রম কি কি হতে পারে সে সম্পর্কে। তার মতে আমেরিকান স্কলারদের কখনো কোন বই সরাসরি অনুসরণ বা অনুকরণ করা উচিত নয় কারণ ফ্রান্সিস বে কোন বা শেক্সপিয়ারের মতো লেখকদের বইগুলো লেখা হয়েছিল শুধুমাত্র ওই সময়ের জন্য। সুতরাং স্কলাররা সেই বই পড়তে পারে কিন্তু তাদেরকে ভাবতে হবে তাদের নিজেদের সময় অনুযায়ী এবং নিজেদের মত করে চিন্তা ভাবনা করতে হবে।।
আবার আমেরিকান স্কলাররা কখনো পৃথিবীর অন্যান্য অংশগুলোর কোন আইডিয়া অনুকরণ করবেন না বা অনুসরণ করবেন না। সারা পৃথিবী যেদিকে হাঁটবে আমেরিকান স্কলারদের হাঁটতে হবে ঠিক তার উল্টো পথে এবং তাদের কার্যক্রম ও আইডিয়া হতে হবে সম্পূর্ণ ইউনিক। তবেই তারা পৃথিবীর শাসন করতে পারবেন এবং তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবী শাসন করতে হবে।